বুধবার, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ম্যানহোলে বস্তাবন্দি শিশুর মরদেহ: আসামী এখনো অজ্ঞাত

এ হত্যাকাণ্ডে তিন থেকে পাঁচ জন জড়িত। হত্যার পর অপরাধীরা জানতো, কোন পথে গেলে ক্যামেরা এড়িয়ে যাওয়া যাবে—এমন পরিকল্পনা করেই লাশ গুমের চেষ্টা করা হয়েছে।

প্রতীকী ছবি

বাংলাফ্লো প্রতিনিধি

ঢাকা: ঢাকার তেজগাঁওয়ের তেজকুনিপাড়া এলাকায় ম্যানহোলে বস্তাবন্দি অবস্থায় সাড়ে চার বছর বয়সী শিশু রোজা মনির মরদেহ উদ্ধারের ১৩ দিন পার হলেও এখনও চিহ্নিত হয়নি হত্যাকারীরা। তবে এলাকাবাসী ও পুলিশ বলছে, ‘হত্যাকারীরা আশপাশেই, তারা এলাকার ভেতরের আত্মগোপনে আছে। ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ক্যামেরা না থাকায় এখনও শনাক্ত করা যাচ্ছে না।

গত ১২ মে দুপুরে বাসার সামনের গলিতে খেলা করছিল রোজা মনি। দুপুর আড়াইটার পর থেকে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। শিশুটিকে খুঁজতে সন্ধ্যা থেকে পাড়া-মহল্লা মাইকিং করে পরিবারটি। অনেক খোঁজাখুঁজির পর পরদিন ১৩ মে সকাল ৭টার দিকে বাড়ির পেছনের ১৮৩/সি নম্বরের একটি ফাঁকা প্লটের ম্যানহোলে বস্তাবন্দি অবস্থায় পাওয়া যায় রোজার নিথর দেহ। পুলিশ জানায়, শিশুটিকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।

পরিবার জানায়, শিশুটির মা শিল্পী বেগম গৃহকর্মীর কাজ করেন। তার বাবা নূরে আলম মালয়েশিয়া প্রবাসী। সাত সন্তানের মধ্যে রোজা মনি ছিল ষষ্ঠ। পরিবারটি মাত্র আট মাস আগে এই এলাকায় বাসা ভাড়া নেয়।

তেজকুনিপাড়া জামে মসজিদের গলিতে ১৮৬/৯-এ নম্বর একটি টিনসেট বাসায় পরিবারের সঙ্গে শিশু রোজা মনির থাকতো। ১২টি রুমের ওই বাড়িতে ১০টি পরিবার ও দুই রুমে কিছু ব্যাচেলর বাস করেন। এই বাড়ির সামনে দিয়ে আরও অন্তত ১৫টি বাড়ি রয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়—একটি বাড়িতেও নেই সিসিটিভি ক্যামেরা!

শিশুটির ভাড়া বাসা থেকে মরদেহ ফেলার স্থান পর্যন্ত কোনও সিসিটিভি ক্যামেরা না থাকলেও তারপর থেকেই একাধিক সিসি ক্যামেরা রয়েছে ওই এলাকায়। এদিকে মহল্লার প্রবেশে রয়েছে তেজকুনিপাড়া জামে মসজিদ। সমজিদের একটি ক্যামেরায় দেখা যায়, ওইদিন দুপুর ২টার দিকে শিশুটি দোকান থেকে চিপস কিনে আবার বাসায় দিকে চলে যায়। এরপর থেকে শিশুটির আর কোনও ক্যামেরায় দেখা যায়নি।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিশুটি যে বাসায় ভাড়া থাকতো তার চারপাশে কোনও সিসিটিভি ক্যামেরা না থাকলেও গলি থেকে বের হওয়া কিংবা আসার ভেতরে একাধিক সিসিটিভি ক্যামেরা রয়েছে। ফলে শিশুটিকে বাসার আশপাশের কোনও একটি বাড়ির ভেতরেই হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়াও শিশুটির মরদেহ যেখানে ফেলা হয়েছে, তার পাশের একটি বাড়িতেও ক্যামেরা রয়েছে। তবে সেটি রাস্তার দিকে কভার করে। ফলে কারা লাশ ফেলেছে, তার কোনও প্রমাণ রাখেনি হত্যাকারীরা। অপরাধীরা কায়দা করে এমনভাবে মরদেহ ফেলেছে, যাতে করে কোনও সিসিটিভি ক্যামেরায় আসামিদের শনাক্ত করা না যায়।

এদিকে বিজয় সরণি লিংক রোড থেকে ২৪১/২ নম্বর মান্নান টাওয়ারের মধ্যে দিয়ে মহল্লায় আসা-যাওয়া করার জন্য একটি সরু গলি রয়েছে। তবে সেটি শুধু নামাজের সময় খোলা থাকে বাকি সময় বন্ধ থাকে। এমনকি মান্নান টাওয়ারে থাকা ক্যামেরাগুলো মহল্লা কভার করে না। ফলে পুলিশ বলছে—শিশুটিকে কোথা থেকে বা কোন বাসা থেকে বের করে এনে লাশ ফেলা হয়েছে, তা প্রমাণ করার মতো ভিডিও ফুটেজ নেই।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিশুটিকে মহল্লার ভেতরের কোনও একটি বাসায় নিয়ে হত্যা করা হয়। এরপর রাতের আঁধারে ক্যামেরা এড়িয়ে তার মরদেহ ফেলে দেওয়া হয় পরিত্যক্ত ম্যানহোলে। এ হত্যাকাণ্ডে তিন থেকে পাঁচ জন জড়িত। হত্যার পর অপরাধীরা জানতো, কোন পথে গেলে ক্যামেরা এড়িয়ে যাওয়া যাবে—এমন পরিকল্পনা করেই লাশ গুমের চেষ্টা করা হয়েছে।

নিহত শিশুর মা শিল্পী বেগম বিভিন্ন বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করেন। বাবা নূরে আলম মালয়েশিয়াপ্রবাসী। আট মাস আগে পরিবারটি তেজকুনিপাড়ায় বসবাস শুরু করে। আগে পাশের আরেকটি বাসায় ছিলেন সাত মাস। বর্তমানে ১৮৬/৯-এ নম্বর টিনসেট বাসায় একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে থাকেন তারা। রোজা মনির ছিল সাত ভাইবোনের মধ্যে ষষ্ঠ। বড় মেয়ে বিবাহিত, আরও দুই মেয়ে গার্মেন্টসে কাজ করেন।

নূরে আলম বলেন, ‘আমাদের এলাকায় কোনও শত্রু নেই। তবে দুই মাস আগে আমার এক মেয়েকে নিয়ে পারিবারিক ঝামেলা হয়েছিল। তবে সেটা মীমাংসা হয়ে গেছে। কারও সঙ্গে আমাদের টাকা-পয়সা বা অন্য কোনও বিরোধ নেই।’

স্থানীয়রা বলছেন, এই হত্যাকাণ্ড এলাকার বাইরের কেউ করতে পারে না। একজন অপরাধী শিশু অপহরণ করে হত্যা করে ম্যানহোলে ফেলে দিয়েছে—কিন্তু কোনও সিসিটিভিতে ধরা পড়েনি, এটা অসম্ভব। তাহলে অপরাধীরা আগে থেকেই জানতো, কোন পথে গেলে ধরা পড়বে না।

‘আমি আমার মেয়ের জন্য আর কিচ্ছু চাই না, শুধু বিচার চাই’ দাবি করে নিহত শিশু রোজা মনির বাবা নূরে আলম বলেন, ‘সরকারের কাছে আমার একটা দাবি—আমার মেয়ের খুনিকে ধরেন, বিচার করেন। খুনিদের যেন এই পৃথিবীতে জায়গা না থাকে। যেন আর কোনও বাবাকে এরকম বুক চাপা কষ্ট নিয়ে বাঁচতে না হয়।’

এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডে উত্তাল হয়ে ওঠে এলাকাবাসী। ১৬ মে জুমার নামাজের পর বিজয় সরণি লিংক রোড অবরোধ করে বিক্ষোভ করে প্রায় তিন শতাধিক নারী-পুরুষ। প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে চলে বিক্ষোভ। তাদের দাবি—রোজা মনির হত্যাকারীরা স্থানীয়ই। কেউ বাইরে থেকে এসে এমন ঘটনা ঘটাতে পারেনি। তারা প্রশ্ন তোলেন, এতদিনেও কেন পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি?

১৫ মে জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ ড্যাব রোজা মনির হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে সুষ্ঠু তদন্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানায়। ঢাকা মহানগর উত্তর ড্যাব সভাপতি অধ্যাপক ডা. সরকার মাহবুব আহমেদ শামীম বলেন, ‘এটি অত্যন্ত হৃদয়বিদারক ও অমানবিক ঘটনা। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি এবং দ্রুততম সময়ে বিচার দাবি করছি।’

তেজগাঁও থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. নাজমুল শাহ জান্নাত বলেন, ‘তদন্ত অনেক দূর এগিয়েছে। আমরা ডিজিটালের পাশাপাশি প্রচলিত পদ্ধতিতেও কাজ করছি। সন্দেহভাজন বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। খুব শিগগিরই আমরা তথ্য-প্রমাণসহ অপরাধীদের গ্রেফতার করতে পারবো বলে আশাবাদী।’

রাজধানীর মাঝখানে এমন ঘটনার ১৩ দিনেও অপরাধীর ধরা না পরার ঘটনায় দেশের নিরাপত্তা ব্যাবস্থা নিয়ে প্রশ্ন ও শঙ্কা প্রকাশ করছেন এলাকাবাসী।

বাংলাফ্লো/আফি

Leave a Comment

Comments 0