বিনোদন প্রতিবেদক: ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’—অমর এই পঙক্তির কবি হেলাল হাফিজ আর নেই (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। লিখেছিলেন, ‘আছি। বড্ড জানান দিতে ইচ্ছে করে, আছি। মনে ও মগজে গুন গুন করে প্রণয়ের মৌমাছি’—হেলাল হাফিজের সেই মৌমাছি গুন গুন চিরতরে থেমে গেছে গতকাল ১৩ ডিসেম্বর। স্বাধীনতা যুদ্ধের বিজয়ের মাসেই তিনি চলে গেলেন, যেই যুদ্ধে যাবার জন্যই সবাইকে তার আগুনের ফুলকির মতো ছড়িয়ে পড়া কবিতা ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’র মাধ্যমে ডাক দিয়েছিলেন—‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে লেখা এই পঙক্তিমালা তাকে প্রথম কবি খ্যাতি এনে দিয়েছিল। তারপর যুদ্ধ হলো, দেশ স্বাধীন হলো, অর্ধশতাব্দী ধরে তার সেই কবিতা আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। সমস্ত জীবন প্রেম আর দ্রোহের পঙক্তি লিখে কবি চলে গেলেন আজ পৃথিবীর সব প্রেম আর যুদ্ধের ঊর্ধ্বে। গত অক্টোবরে তার জন্মদিনের প্রাক্কালে বলেছিলেন ‘আমি লাস্ট স্টেইজে আছি।’ গতকাল শুক্রবার সেই ‘লাস্ট স্টেইজ’ ও পার করে কবি চলে গেলেন। গতকাল দুপুর আড়াইটার দিকে কবিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে মৃত অবস্থায় আনা হয় বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কবি থাকতেন এ হাসপাতালেরই ঠিক পাশে শাহবাগের সুপার হোস্টেলে। গতকাল হোস্টেল কক্ষের ওয়াশরুমের দরজা খুলে তাকে পড়ে থাকতে দেখেন অন্যরা। তিনি ওয়াশরুমে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পেয়েছিলেন বলে জানা যায়। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত হোটেল ঘরেই কাটিয়ে দিলেন কবি। এর আগে এক যুগের বেশি বসবাস করেছেন প্রেস ক্লাব সংলগ্ন কর্ণফুলী হোটেলে। কয়েক বছর ধরে শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। শক্তি কমে গিয়েছিল, রুচি কমে গিয়েছিল, বেশিক্ষণ কথা বললে শাসকষ্ট হতো। চোখে গ্লুকোমা আক্রান্ত হয়ে ভুগছিলেন অনেক বছর ধরে। ৭৬ বছরের জীবনে কবি হেলাল হাফিজ অনেকটা সংসারত্যাগী জীবন কাটিয়ে গেছেন। মাতৃহীনতা, প্রেমের বিরহ-বেদনা যাকে কবি করে তুলেছিল, তিনি লিখেছিলেন—‘বেদনা কে বলেছি কেঁদো না’। কিন্তু মানুষের দুঃখ-বেদনাকে এত নিপুণভাবে যে কবি এঁকে গেলেন জীবনভর, তার মৃত্যুতে বেদনাও নিশ্চয়ই কেঁদে ওঠে! প্রিয় বেদনাকে কাঁদিয়েই চলে গেলেন হেলাল হাফিজ। প্রধান উপদেষ্টার শোক: কবি হেলাল হাফিজের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো শোকবার্তায় ড. ইউনূস বলেন, দ্রোহ ও প্রেমের কবি হেলাল হাফিজের মৃত্যু বাংলা ভাষা ও সাহিত্য অঙ্গনের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। প্রধান উপদেষ্টা কবির পরকালীন জীবনের শান্তি কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। তিনি বলেন, কবি হেলাল হাফিজ ছিলেন তারুণ্যের শক্তি এবং স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক সাহসী কণ্ঠ। তার কালজয়ী কবিতার মতোই তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন মানুষের হৃদয়ে। কবি হেলাল হাফিজের প্রথম জানাজা আজ শনিবার বেলা ১১টায় বাংলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত হবে। কবির বড় ভাই দুলাল হাফিজ গতকাল এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি জানান, রোববার বাদ জোহর জাতীয় প্রেস ক্লাবে দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হবে। কবির মরদেহ গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনায় নেওয়া হবে না বলেও জানান তিনি। কবি হেলাল হাফিজের লেখালেখির সূচনা ষাটের দশকের উত্তাল সময়ে। তবে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ প্রকাশিত হয় দেশ স্বাধীন হওয়ারও অনেক পরে, ১৯৮৬ সালে। এই একটিমাত্র কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে বাংলা কবিতার জগতে অমর হয়ে গেলেন কবি হেলাল হাফিজ। ৩৫টিরও বেশি সংস্করণ প্রকাশ হয়েছিল এ কাব্যগ্রন্থটির। ২৬ বছর পর ২০১২ সালে প্রকাশিত হয় তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতা একাত্তর’। ২০১৯ সালে প্রকাশ পায় কবির সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’। এই গ্রন্থগুলোর মধ্য দিয়ে লড়াইয়ে, সংগ্রামে, প্রেমে-বিরহে, দ্রোহে যাপিত জীবনের নানান স্তরে কবি হেলাল হাফিজ তার কবিতায় অনুরণিত করে গেছেন আপামর বাঙালির হৃদয়। ১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর নেত্রকোনার আটপাড়া উপজেলার বড়তলী গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বাবা খোরশেদ আলী তালুকদার পেশায় ছিলেন স্কুল শিক্ষক, আর মা কোকিলা বেগম গৃহিণী। শৈশবেই মাকে হারান কবি। সেই বেদনাই তাকে পরবর্তী সময়ে কবি করে তোলে। ১৯৬৫ সালে নেত্রকোনা দত্ত হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ১৯৬৭ সালে নেত্রকোনা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে একই বছরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। কবি হেলাল হাফিজের লেখালেখির সূচনা ষাটের দশকের উত্তাল সময়ে। অনেকটা বোহেমিয়ান জীবন কাটালেও কবি হেলাল হাফিজ প্রথম জীবনে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবস্থায় ১৯৭২ সালে সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন দৈনিক পূর্বদেশে। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন তিনি। পূর্বদেশ বন্ধ হয়ে গেলে ১৯৭৬ সালের শেষদিকে হেলাল হাফিজ দৈনিক দেশ পত্রিকায় সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। সর্বশেষ দৈনিক যুগান্তরে ফিচার সম্পাদক ছিলেন। কবিতায় অসামান্য অবদানের স্মারক হিসেবে হেলাল হাফিজ পেয়েছেন বেশ কয়েকটি পুরস্কার। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য যশোহর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার (১৯৮৬), আবুল মনসুর আহমদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৭), নেত্রকোনা সাহিত্য পরিষদের কবি খালেকদাদ চৌধুরী পুরস্কার ও সম্মাননা এবং ২০১৩ সালে পান বাংলা একাডেমি পুরস্কার। নিজের কবিতা সম্পর্কে স্বগতোক্তি করতে গিয়ে কবি বলেছিলেন—‘বেদনাগুলোকে যতটুকু আমার সামর্থ্যে কুলিয়েছে, ‘যে জলে আগুন জ্বলে’তে আমি বের করে দিয়েছি। এবং আমি খুব সচেতনভাবে চেষ্টা করেছি, যে আমার কোনো প্রেমের কথা, আমার কোনো বিরহের কথা, আমার কোনো দুঃখের কথা, আমার কোনো রাজনীতির কথা—এগুলো যখন আমি কবিতায় রূপান্তর করব, তা পড়ে প্রত্যেক মানুষ যেন মনে করে, আরে এটা তো আমারই কথা। সে কারণেই হয়তো আমার কবিতার কাছে যিনি রাজনীতির মানুষ, তিনিও গিয়ে আশ্রয় পেয়েছেন। যে প্রেমিক সেও আশ্রয় পেয়েছে। যিনি বিচ্ছেদে আক্রান্ত, জর্জরিত তিনিও আমার কাছে গিয়ে আশ্রয় পেয়েছেন। এ এক অদ্ভূত ব্যাপার। প্রায় ছাব্বিশ বছর লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকেছি। কিন্তু আজ যখন সেসব দিনের কথা ভাবি—দিনগুলো আমার কাছে নিবিড়ভাবে ধরা দেয় এখনও। তবে জীবনে আমার কোনো আক্ষেপ নেই। অনুশোচনা নেই, এই যে এত সময় অপচয় করলাম! বরং অপরাধ বোধ আছে। তবে বেঁচে থাকি আর মরে যাই, সেটা যাই হোক না কেন, আমি আমার কবিতার মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকতে পারব আরও বেশ কিছুকাল—এটা ভেবে স্বস্তি পাই। আর যদি বিদায় জানাতে না পারি—আমার বেদনার ফুলগুলো দিয়ে যাই ‘আপনাকে, তোমাকে, তোকে’।