বৃহস্পতিবার, ৭ আগস্ট ২০২৫

ড্রিমস অব বাংলাদেশের চন্দ্রাভিলাষ

আগামী ২৮ মার্চ ঢাকা ছাড়বে ‘ড্রিমস অব বাংলাদেশ’-এর সদস্যরা। নাসার প্রতিযোগিতায় প্রথমবার অংশ নিচ্ছে বাংলাদেশের মুন-রোভার দলটি। সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে তাদের তৈরি চন্দ্রযান ‘মাইরেজ ১’। ‘ড্রিমস অব বাংলাদেশ’-এর স্বপ্ন, একদিন চাঁদের ধূসর মাটিতে উড়বে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা।

ডেস্ক নিউজ: আগামী ২৮ মার্চ ঢাকা ছাড়বে ‘ড্রিমস অব বাংলাদেশ’-এর সদস্যরা। নাসার প্রতিযোগিতায় প্রথমবার অংশ নিচ্ছে বাংলাদেশের মুন-রোভার দলটি। সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে তাদের তৈরি চন্দ্রযান ‘মাইরেজ ১’। ‘ড্রিমস অব বাংলাদেশ’-এর স্বপ্ন, একদিন চাঁদের ধূসর মাটিতে উড়বে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা।

এমন স্বপ্ন নিয়ে পাঁচ মাস আগে যাত্রা শুরু করে ‘ড্রিমস অব বাংলাদেশ’। মহাকাশ গবেষণার জগতে বাংলাদেশের তরুণ অগ্রযাত্রীদের এই যাত্রা সহজ ছিল না। এর পেছনে রয়েছে তাদের অনেক রাত জাগার গল্প, পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর অদম্য জেদ। মুন ল্যান্ডার রোভার টিমকে নেতৃত্বে রয়েছেন ‘এ’ লেভেল পরীক্ষার্থী সানজিম হোসাইন।

প্রজেক্ট লিড ও সহদলনায়ক বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফ পাবলিক কলেজের শিক্ষার্থী মাহদির ইসলাম। ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের শিক্ষার্থী আন নাফিউ দলের সেফটি অফিসার, মেকানিক্যাল লিড ঢাকার সিপিআই পলিটেকনিকের শিক্ষার্থী মো. রিফাত হোসাইন, টেকনিক্যাল লিড বিএএফ শাহীন কলেজের শিক্ষার্থী মো. ইয়াসিন আরাফাত, সফটওয়্যার লিড দিচ্ছেন ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের শিক্ষার্থী অর্কপ্রতীক আচার্য, সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী মার্জিয়া আফিফা পৃথিবী দলের ইলেকট্রিক লিডার ও রোভারের ডিজাইন লিডার ঢাকা ইমপিরিয়াল কলেজের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল জুনায়েদ। দলের উপদেষ্টা হিসেবে আছেন এমআইএসটির মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রভাষক শাহ মো. আহসান সিদ্দিক। এমআইএসটির প্রতিনিধি ও মেন্টর হিসেবে দলকে পথ দেখাচ্ছেন জওয়াদুর রহমান ও মো. ফয়সাল হোসেন।

মাইরেজ ১-এর বৈশিষ্ট্য

ড্রিমস অব বাংলাদেশের চন্দ্রাভিলাষপ্রথমে চার চাকার একটি রোভার ডিজাইন করে ‘ড্রিমস অব বাংলাদেশ’-এর সদস্যরা। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে ট্রায়ালে দেখা যায়, অসমতল ভূমিতে চলতে হিমশিম খাচ্ছে এটি। ভারসাম্য বজায় রাখা হয়ে পড়ে কঠিন এবং মাটি পরীক্ষার সময় প্রথম ডিজাইনটি একদম উড়ে যায়—জানালেন দলনেতা সানজিম হোসেন। হতাশ না হয়ে ফের সবাই মিলে রোভারটির পুনর্নির্মাণ করেন তারা। নতুন ডিজাইনে ছয় চাকার একটি কনফিগারেশন করা হয়, যা নাসার মঙ্গল গ্রহে পাঠানো কিউরিওসিটি রোভারের মতো অনেকটা, রকার-বগি সাসপেনশন সিস্টেম ব্যবহার করে তৈরি।

নতুন ডিজাইনটি রোভারকে অত্যন্ত বিষম ভূমিতেও সহজে চলাচল করতে সাহায্য করে। যখন এর কোনো একটি চাকা বাধার সম্মুখীন হয়, তখন অন্য চাকাগুলো তাকে সামলে নেয়।

রোভারটির দৈর্ঘ্য ৭০০ মিমি, প্রস্থ ৪৬০ মিমি, উচ্চতা ২৮০ মিমি, হুইলবেস ১৮০ মিমি, গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স ৩৬০ মিমি। হালকা কিন্তু টেকসই নানা উপাদান ব্যবহার করে রোভারটি নির্মাণ করা হয়েছে। কার্বন ফাইবার টিউব ব্যবহার করা হয়েছে কাঠামোগত শক্তি বাড়াতে, পলিল্যাকটিক এসিড ব্যবহার করা হয়েছে প্রোটোটাইপিং ও হালকা কম্পোনেন্টের জন্য, থার্মোপ্লাস্টিক পলিউরেথেন ব্যবহার করা হয়েছে নমনীয় জয়েন্ট ও প্রভাব প্রতিরোধী অংশের জন্য, যেমন এর চাকায়। ফ্রেম ও ভার বহনকারী কাঠামো তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে অ্যালুমিনিয়াম বার।

সফটওয়্যার লিডার অর্কপ্রতীক আচার্য বলেন, রোভারটির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো এর অত্যাধুনিক সেন্সিং এবং নেভিগেশন সিস্টেম। এতে ইন্টিগ্রেটেড স্ল্যামটেক আরপি-লাইডার সিস্টেম রয়েছে, যা ৩৬০ ডিগ্রি দৃষ্টিকোণ থেকে আশপাশের জমি ম্যাপ করতে পারে। টাইম অব ফ্লাইট প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই লাইডার লেজার রশ্মি ছড়িয়ে বিষয়বস্তুর দূরত্ব পরিমাপ করার মাধ্যমে বিস্তৃত পয়েন্ট ক্লাউড তৈরি করে, যা প্রক্রিয়াকরণের ফলে তৈরি হয় ২ডি মানচিত্র।

সহদলনেতা মাহদির ইসলাম বলেন, আমাদের রোভারের সিস্টেমের বড় সাফল্য হলো এটি অন্ধকারে, ধুলাচ্ছন্ন অবস্থায়, এমনকি বৈরী আবহাওয়ায়ও সঠিকভাবে ডেটা সংগ্রহ করতে পারে। পরীক্ষাগারের নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে এটি তথ্য সংগ্রহে ৯৮ শতাংশ নির্ভুলতার হার অর্জন করেছে।

রোভারটির মূল হৃত্স্পন্দন এর কেন্দ্রীয় প্রসেসিং ইউনিট এবং যোগাযোগব্যবস্থা। ইএসপিভিত্তিক মাইক্রোকন্ট্রোলার রোভারের মস্তিষ্ক হিসেবে কাজ করে এবং সব ডেটা প্রসেসিং ও রোভার নিয়ন্ত্রণের কাজও করে এটি। এর সঙ্গে সংযুক্ত একটি রিসিভার ইউনিট আছে, যা প্রধান রিমোট কন্ট্রোলারের সঙ্গে বেতার যোগাযোগ স্থাপন করে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি বা ওয়াই-ফাই প্রটোকলের মাধ্যমে। রোভারটিতে আরও সজ্জিত ছয়টি ডিসি মোটর, মোটর ড্রাইভার মডিউল, উচ্চ রেজল্যুশনের দৃশ্য ধারণের ক্যামেরা সিস্টেম এবং বিশেষভাবে ডিজাইন করা পাওয়ার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম দিয়ে, যা লিথিয়াম পলিমার ও ১৮৬৫০ ব্যাটারির সমন্বয়ে তৈরি।

মাটি সংগ্রহের মেকানিজম

দলটির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদ্ভাবনের মধ্যে একটি হচ্ছে তাদের নিজস্ব ডিজাইনের মাটি সংগ্রহের মেকানিজম। শুরুতে তারা একটি ড্রিলিং সিস্টেম ডিজাইন করেছিল, যা ছিল স্কুপজাতীয় কাঠামোসহ একটি একচুয়েটরের সঙ্গে সংযুক্ত। কিন্তু দুই ধরনের নমুনা সংগ্রহের কারণে তারা দুটি সম্পূর্ণ সংগ্রহব্যবস্থা রোভারে অন্তর্ভুক্ত করেছিল, যা রোভারকে অত্যধিক ভারী করে তুলেছিল। এই সমস্যা সমাধানের জন্য তারা সম্পূর্ণ নতুন একটি ডিজাইন করেন। যার মধ্যে রয়েছে একটি ছয় ইঞ্চি আর্থ অগার ড্রিল বিট ও একটি একচুয়েটর সিস্টেম।

অর্কপ্রতীক আচার্য বলেন, চন্দ্রপৃষ্ঠের নমুনা সংগ্রহে কোনো ত্রুটি থাকুক আমরা চাইনি। আমাদের সিস্টেম এত নিখুঁত যে এটি ক্রস-কন্টামিনেশন ছাড়াই দুটি আলাদা নমুনা সংগ্রহ করতে পারে।

নাসা প্রতিযোগিতা: চ্যালেঞ্জ

নাসা হিউম্যান এক্সপ্লোরেশন রোভার চ্যালেঞ্জে দুটি প্রধান মিশনে অংশ নিচ্ছে ড্রিমস অব বাংলাদেশ। প্রথমটি হলো মাটির নমুনা সংগ্রহ, যেখানে রোভারকে ক্রস-কন্টামিনেশন এড়িয়ে দুটি আলাদা স্থান থেকে মাটি সংগ্রহ করতে হবে। দ্বিতীয়টি হলো টেরেইন ম্যাপিং, যেখানে রোভার লাইডার ব্যবহার করে আশপাশের অঞ্চলের একটি বিস্তৃত মানচিত্র তৈরি করবে। এছাড়া ধূলিময়, অসমান ভূমিসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক বাধা অতিক্রম করার ক্ষমতা পরীক্ষা করবে। প্রতিটি বাধার জন্য বিস্তৃত কৌশল তৈরি করেছে ড্রিমস অব বাংলাদেশ।

যুক্তরাষ্ট্রের হান্টসভিল, অ্যালাবামায় অবস্থিত ইউএস স্পেস অ্যান্ড রকেট সেন্টারে অনুষ্ঠিত হবে এ প্রতিযোগিতা। এতে হিউম্যান পাওয়ার এবং রিমোট কন্ট্রোল, মোট দুটি বিভাগে বিভিন্ন দেশের ৭৫টি দল অংশ নিচ্ছে। রিমোট কন্ট্রোল বিভাগে ড্রিমস অব বাংলাদেশের সঙ্গে অংশ নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, থাইল্যান্ড ও ব্রাজিলসহ বিভিন্ন দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মোট ২৫টি দল।

১১ ও ১২ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হবে প্রতিযোগিতার প্রধান পর্ব। প্রতিটি দলের ডিজাইন করা রোভারের কার্যক্ষমতা পরীক্ষা করা হবে চন্দ্রপৃষ্ঠের আদলে তৈরি পরিবেশে। প্রতিটি দলের তৈরি রোভারের কার্যক্ষমতা ছাড়াও এর ডিজাইন ডকুমেন্টেশন, দলটি নিজেদের চিন্তা সাবলীলভাবে তুলে ধরতে পারছে কি না—এমন বেশ কিছু ক্ষেত্রে প্রতিটি দলকে নম্বর দেওয়া হবে। প্রতিযোগিতা শেষে দলের প্রাপ্ত মোট স্কোর অনুযায়ী নির্ধারণ করা হবে বিজয়ী।

প্রত্যাশা

প্রতিযোগিতার প্রস্তুতি হিসেবে ড্রিমস অব বাংলাদেশ নিরন্তর তাদের রোভারের পারফরম্যান্স পরীক্ষা করেছে। সফটওয়্যার আপডেট করছে এবং বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলার অনুশীলন করছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে তারা শুধু শিল্প-প্রযুক্তিগত দক্ষতাই অর্জন করেনি, বরং দলগত কাজ, সমস্যা সমাধান এবং জটিল প্রকল্প ব্যবস্থাপনার দিকেও নজর রেখেছে। দলটি আশা করছে, প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েই ফিরবে।

জেবি