বাংলাফ্লো প্রতিনিধি
ঢাকা: টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে ফেনীতে মুহুরী ও সিলোনিয়া নদীর বাঁধের দুটি স্থান ভেঙে অন্তত ৯ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া পরশুরাম উপজেলার সিলোনিয়া নদীর বেড়িবাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে।
বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) বিকাল থেকে সিলোনিয়া নদীর বেড়িবাঁধ উপচে পানি ঢুকতে শুরু করে এবং রাতে মুহুরী ও সিলোনিয়া নদীতে ভাঙন দেখা দেয় বলে জানিয়েছেন ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. আবুল কাশেম।
তিনি বলেন, টানা কয়েক দিনের মুষলধারে বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে মুহুরী নদী, সিলোনিয়া নদী ও কহুয়া নদীতে পানি বাড়তে শুরু করে।
প্রবল পানির তোড়ে বৃহস্পতিবার রাত ১০টার পর ফুলগাজী উপজেলার সদর ইউনিয়নের বণিক পাড়া গ্রামের সহদেব বৈদ্যের বাড়ি-সংলগ্ন মুহুরী নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধের প্রায় ৫০ মিটার অংশ ভেঙে গেছে।
পরে সিলোনিয়া নদীর বেড়িবাঁধের গোসাইপুর এলাকায় একটি অংশেও বেশকিছু মিটার ভাঙনের সৃষ্টি হয়। এতে ওই এলাকার বেশকিছু গ্রামে পানি প্রবেশ করে।
ফুলগাজীর স্থানীয় বাসিন্দা শাহাব উদ্দিন বলেন, বেড়িবাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে পানি ঢুকে উপজেলার উত্তর বড়ইয়া, দক্ষিণ বড়ইয়া, বনিপাড়া, বিজয়পুর, বসন্তপুর, জগৎপুর, গোসাইপুর, নীলক্ষী, করইয়া গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
বড়ইয়া গ্রামের বাসিন্দা মরণ চন্দ্র বলেন, “বৃহস্পতিবার রাত থেকে নদীর পানি ঘরে পানি ঢুকে পড়ায় শিশুসহ ঘরের সকলে পানিবন্দি হয়ে পড়েছি। ঘরের আসবাবপত্র সব পানিতে ডুবে রয়েছে। চুলা জ্বালাতে না পারায় রাত থেকে রান্না করা খাবার গ্রহণ বন্ধ রয়েছে৷”
এদিকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মুহুরী নদী সংলগ্ন ফুলগাজী বাজারের গার্ডওয়াল উপচে পানি বাজারে প্রবেশ করে। রাতভর ফুলগাজী বাজার হাঁটুপানিতে নিমজ্জিত থাকলেও শুক্রবার ভোর থেকে পানি নেমে যায়।
বাজারের ব্যবসায়ী কবির আহমদ বলেন, “প্রতি বছর বর্ষাকালে ফুলগাজী বাজার পানিতে ডুবে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দীর্ঘদিন ধরে এর প্রতিকার চেয়েও পানি উন্নয়ন বোর্ড শুধু আশ্বাসে সীমাবদ্ধ রেখেছে।”
অপরদিকে সিলোনিয়া নদীতে পানি বেড়ে যাওয়ায় পরশুরাম উপজেলার মির্জানগর ইউনিয়নের সুবার বাজারের দক্ষিণ ও উত্তর পাশে মনিপুর গ্রামের চারটি ভাঙা (পূর্বের ভাঙন) অংশ দিয়ে প্রবলবেগে পানি প্রবেশ করছে।
হু হু করে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করায় স্থানীয়দের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ হাসান বলেন, ২০২৪ সালের ভয়াবহ বন্যার পর সিলোনিয়া নদীর বেড়িবাঁধের ভাঙ্গনগুলো মেরামত না করায় গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। গত বছরের বন্যার ধকল এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি পরশুরাম উপজেলার মানুষ। এখন পানি দেখলেই বুক ধড়ফড় করে।
উপজেলার মনিপুর গ্রামের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, “বেড়িবাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে পানি ঢুকায় আমরা ভয়ের মধ্যে আছি। যেকোনো সময় বাড়ি-ঘরে পানি উঠতে পারে। আমাদের এলাকায় নতুন করে বন্যার আশংকা দেখা দিয়েছে।”
পানি উন্নয়ন বোর্ড, উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্র জানায়, ২০২৪ সালে অগাস্টের ভয়াবহ বন্যায় সীমান্তবর্তী মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বেড়িবাঁধের শতাধিক স্থানে ভাঙন সৃষ্টি হয়। ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় কয়েক লাখ মানুষ।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, তিনটি নদীর বেড়িবাঁধের ৫২টি স্থানে ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়েছিল। তারমধ্যে অধিকাংশ বাঁধই মেরামত করা হয়েছে, তবে বেড়িবাঁধের ১০-১২টি অংশ এখনো মেরামত না হওয়ায় এসব স্থান দিয়ে জনপদে পানি ঢুকতে শুরু করেছে।
দক্ষিণ কোলাপাড়া প্রফেসর বাড়ি সংলগ্ন কহুয়া নদীর বেড়িবাঁধ, ধনীকুন্ডা-নোয়াপুর সড়কের ২০০ ফুট বেড়িবাঁধ, পশ্চিম অলকায় ৩টি স্থান, মির্জানগর ইউনিয়নের মনিপুরে সিলোনিয়া নদীর বেড়িবাঁধের ৪টি স্থান, দক্ষিণ সত্যনগরে সিলোনিয়া নদীর বেড়িবাঁধের ৪০ ফুটসহ বিভিন্ন স্থানের বেড়িবাঁধ মেরামত করা হয়নি।
এসব বেড়িবাঁধ দিয়ে গত দুইদিন ধরে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে।
এছাড়া মেরামতকৃত বেড়িবাঁধের আটটি স্থানে নতুন করে ফাটল ও ভাঙন দেখা দিয়েছে বলে অভিযোগ পরশুরাম উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে স্থানীয়দের। চিথলিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ শালধরে মুহুরী বেড়িবাঁধের মাঝখানে ফাটল দেখা দিয়েছে; বেড়িবাঁধের দুইদিকে দেবে গেছে।
ফুলগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফাহরিয়া ইসলাম বলেন, মুহুরী নদীর বেড়িবাঁধের ভাঙ্গনের খবর পেয়ে তিনি ও জোলা প্রশাসক বৃহস্পতিবার রাতেই ঘটনাস্থলে ছুটে যান। পরে সেনাবাহিনীর সদস্যরা ভাঙ্গনকবলিত অংশ পরিদর্শন করেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী (পুর) ওয়াসিম আকরাম বলেন, বৃহস্পতিবার বিকাল থেকে ভারী বর্ষণ বন্ধ থাকায় মুহুরী নদীতে পানি কমতে শুরু করেছে। শুক্রবার সকাল ৯টা পর্যন্ত মুহুরী নদীর পানি ১১ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এই নদীতে পানির বিপদসীমা ১২ দশমিক ৫৫ সেন্টিমিটার।
জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, মুহুরী নদীর বেড়িবাঁধের ভাঙা অংশ জরুরি ভিত্তিতে মেরামত করার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নতুন করে বাঁধের আর কোনো অংশ যেন না ভাঙে সেই বিষয়ে খেয়াল রাখা হচ্ছে। বাঁধটি যেহেতু মাটির, নদীতে পানি বাড়লেই যে কোনো পয়েন্টে ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ফেনীর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আক্তার হোসেন মজুমদার জানান, মুহুরী বাঁধের যে অংশটি ভেঙেছে সেটি আরসিসি ঢালাই করা। যেখানে মাটির বাঁধ ভেঙে যাওয়ার শঙ্কা ছিল সেখানে মাটির বাঁধের উপরে আরসিসি ঢালাই করা অংশটিও ধসে পড়েছে।
বেড়িবাঁধের ভাঙা অংশগুলো মেরামতের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা তৎপর আছে জানিয়ে তিনি বলেন, “ তবে পানি না কমলে তাৎক্ষণিকভাবে এটি মেরামত করা সম্ভব নয়।”
বাংলাফ্লো/এনআর
Comments 0