Logo

সম্পর্ক উষ্ণ রাখার আহ্বান দিল্লির, শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্যে আপত্তি ঢাকার

বৈঠকে বাংলাদেশের সঙ্গে ইতিবাচক ও গঠনমূলক সম্পর্ক গড়ে তোলার ব্যাপারে ভারতের আগ্রহের কথা জানিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। পাশাপাশি গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে দুই দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো সমাধানের প্রত্যাশাও ব্যক্ত করেন তিনি।

শুক্রবার ব্যাংককে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ছবি: প্রেস উইং

বাংলা ফ্লো ডেস্ক

ঢাকা: ব্যাংককে অনুষ্ঠেয় বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে প্রথমবার সাইডলাইন বৈঠক হয়েছে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির। দুই নেতার সেই বৈঠকে আলোচনা হয়েছে এমন সব বিষয়ের মধ্যে অন্যতম ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ ইস্যু। ভারতে বসে শেখ হাসিনার বিভিন্ন উসকানিমূলক বক্তব্যের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছে ঢাকা। অপরদিকে, প্রতিবেশী দেশের তরফ থেকেও এসেছে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে স্থিতিশীলতা আনে এমন আবহের মধ্য থেকেই মন্তব্য করার প্রতি স্পষ্ট আলোকপাত।

বৈঠকে বাংলাদেশের সঙ্গে ইতিবাচক ও গঠনমূলক সম্পর্ক গড়ে তোলার ব্যাপারে ভারতের আগ্রহের কথা জানিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। পাশাপাশি গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে দুই দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো সমাধানের প্রত্যাশাও ব্যক্ত করেন তিনি।

সম্প্রতি চীন সফরে গিয়ে ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় ৭ রাজ্য বা সেভেন সিস্টার্স নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন ইউনূস। ভারতের রাজনীতিবিদরা বিষয়টি ভালোভাবে নেননি এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এর ব্যাপক সমালোচনা করেছেন। ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকের সময়ে হয়ত সেদিকেই ইঙ্গিত দিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী।

বৈঠক বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি গণমাধ্যমকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে প্রথমবারের মতো আলোচনায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকা-দিল্লির দ্বিপক্ষীয় পরিবেশ খারাপ হয়—এমন বক্তব্য পরিহার করার আহ্বান জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, নরেন্দ্র মোদি আশা প্রকাশ করেছেন, ভবিষ্যতে ভারত এমন এক গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক স্থিতিশীল বাংলাদেশ দেখতে চায়, যেখানে নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ।

শুক্রবার (৪ এপ্রিল) দুপুরে ব্যাংককের সাংরিলা হোটেলে ইউনূস-মোদি বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব তথ্য জানান। থাইল্যান্ডের রাজধানীতে ষষ্ঠ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলন শেষে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে বিক্রম মিশ্রি বক্তব্য দেন। এরপর তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন।

ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বলেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একটি গণতান্ত্রিক, স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ, প্রগতিশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের প্রতি ভারতের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতের জনকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন, দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা উভয় দেশের জনগণের জন্য বাস্তব সুবিধা বয়ে এনেছে। তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে বাস্তবতার নিরিখে একটি ইতিবাচক ও গঠনমূলক সম্পর্ক গড়ে তুলতে ভারতের আকাঙ্ক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন।

বিক্রম মিশ্রি বলেন, প্রধানমন্ত্রী আহ্বান জানিয়েছেন, পরিবেশকে খারাপ করে, এমন বক্তব্য এড়িয়ে চলাই সর্বোত্তম।

এর আগে বিমসটেক সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘সেভেন সিস্টার্স’ নামে পরিচিত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাত রাজ্যকে ‘ল্যান্ডলকড’ বা ভূবেষ্টিত আখ্যা দিয়ে বলেছিলেন, ভারতের এই রাজ্যগুলোর সমুদ্রে প্রবেশের ক্ষেত্রে একমাত্র অভিভাবক বাংলাদেশ। বিষয়টিকে ভালোভাবে নেয়নি ভারত।

এর পাল্টাজবাব দিয়েছে প্রতিবেশী দেশটি। ড. ইউনূসের মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় সেভেন সিস্টার্সকে বিমসটেকের কেন্দ্রবিন্দু দাবি করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জোর দিয়ে বলেছেন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ‘আন্তঃআঞ্চলিক গোষ্ঠীর’ (বিমসটেক) কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত, যা এই অঞ্চলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর প্রাধান্যকেই তুলে ধরে। এদিকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও বলেছেন, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ‘বিমসটেকের জন্য একটি সংযোগ কেন্দ্রে’ পরিণত হয়েছে।

বিক্রম মিশ্রি জানান, সীমান্তে আইনের কঠোর প্রয়োগ ও অবৈধ সীমান্ত অতিক্রম প্রতিরোধ, বিশেষ করে, রাতে সীমান্ত অতিক্রম ঠেকানো সীমান্ত নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় বলে উল্লেখ করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক পর্যালোচনা ও এগিয়ে নেওয়ার জন্য দুই দেশের প্রতিনিধিরা বৈঠক করতে পারেন বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী দৃঢ় বিশ্বাস ব্যক্ত করেছেন, দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক স্বার্থের সব বিষয় গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধান অব্যাহত থাকবে। আর এটি হবে দুই দেশের দীর্ঘস্থায়ী ও পারস্পরিকভাবে উপকারী দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের স্বার্থে।

বিক্রম মিশ্রি বলেন, প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে হিন্দুসহ সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিয়ে ভারতের উদ্বেগের কথা তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশ সরকার সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর সদস্যদের ওপর সংঘটিত নৃশংসতার সব ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করবে বলেও আশা প্রকাশ করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।

নরেন্দ্র মোদি বিমসটেকের সভাপতিত্ব গ্রহণের জন্য বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। ফোরামের নেতৃত্বে আঞ্চলিক সহযোগিতা আরও এগিয়ে নেওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। ফোরামের সদস্য দেশগুলোর নেতারা বিমসটেক কাঠামোর আওতায় আঞ্চলিক একত্রীকরণ প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে পরামর্শ দেওয়া ও সহযোগিতা বাড়াতে সম্মত হয়েছেন।

শেখ হাসিনাকে প্রত্যপর্ণের বিষয়ে অধ্যাপক ইউনূস অনুরোধ করেছেন কি না, জানতে চাইলে বিক্রম মিশ্রি বলেন, ‘শেখ হাসিনার বিষয়টি আর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যে অনুরোধ এসেছে, বিষয়টি নিয়ে কথাবার্তা হয়েছিল। আর আমাদের যে মুখপাত্র, তিনি এ বিষয়ে আপনাদের অবগত করেছেন। আমাদের কাছে এ বিষয়ে একটি আবেদন এসেছিল। তা নিয়ে আর কিছু বলা আমার এখন সমীচীন হবে না।’

সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে দুই নেতার বৈঠকে আলোচনার বিষয়ে জানতে চাইলে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘সেখানে (বাংলাদেশে) যে অবস্থা আর তা নিয়ে দুই নেতার মধ্যে যে কথাবার্তা হয়েছে, আমি আমার বক্তব্যে যেমনটি জানিয়েছি, প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি খোলাখুলি সামনে এনেছেন। এ বিষয়ে আমাদের গভীর উদ্বেগ তিনি ব্যক্ত করেছেন। বাকি সমাজে এর যে প্রভাব, তা নিয়ে তিনি অধ্যাপক ইউনূসকে অবগত করেছেন।’ এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের যে দায়িত্ব, সেটা তারা পালন করবে বলে তিনি আশা করেন।

বাংলাদেশে নির্বাচনের বিষয়ে আলোচনা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বিক্রম মিশ্রি বলেন, ‘যেকোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নিয়মিত অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার। আমাদের প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়েও অধ্যাপক ইউনূসকে অবগত করেছেন। জানিয়েছেন, ভবিষ্যতে আমরা একটি গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক স্থিতিশীল বাংলাদেশ দেখতে পাব। এ ব্যাপারে নির্বাচনের একটি ভূমিকা রয়েছে, তা সবাই জানেন।’

অন্যদিকে, আধা ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চলা এই বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণসহ বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় তুলে ধরা হয় বলে জানান প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ও ভারত—দুই দেশের সরকার প্রধানের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকটি অত্যন্ত গঠনমূলক ও ফলপ্রসূ হয়েছে। আমাদের সঙ্গে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট সব ইস্যুতে আলোচনা হয়েছে।’

প্রেস সচিব বলেন, শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ এবং ভারতে বসে তিনি উসকানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন, এসব বিষয় বৈঠকে তুলে ধরা হয়েছে। এ ছাড়া সীমান্তে হত্যা, তিস্তা নদীর পানি বণ্টনসহ পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, বঙ্গোপসাগরীয় দেশগুলোর আঞ্চলিক সহযোগিতা জোটের (বিমসটেক) শীর্ষ সম্মেলন ২ থেকে ৪ এপ্রিল ব্যাংককে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

বাংলাফ্লো/এসবি

Leave a Comment

Comments 0