বাংলাফ্লো আন্তর্জাতিক ডেস্ক
ঢাকা: ভারত শাসিত জম্মু-কাশ্মীরের পেহেলগামে সাম্প্রতিক সময়ে সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। এই উত্তেজনা সামরিক সংঘাতে রূপ নেওয়ার আশঙ্কা বাড়াচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এরইমধ্যে উত্তেজনা নিরসনসহ সংকট সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে।
তবে ভারত এখন সংঘাত এড়াতে নয় বরং পাকিস্তানে সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য যুক্তি তৈরির চেষ্টা করছে —এমনটাই জানিয়েছে প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমস।
গতকাল রোববার প্রকাশিত নিউইয়র্ক টাইমস-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কাশ্মীরে হামলার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইতোমধ্যে বিশ্বের এক ডজনের বেশি দেশের নেতাদের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। পাশাপাশি দিল্লিতে অবস্থিত শতাধিক কূটনৈতিক মিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিয়মিত আলোচনা চালাচ্ছে।
তবে ভারতের এই প্রচেষ্টা মূলত আন্তর্জাতিক সহায়তা চাইতে নয়, বরং সামরিক অভিযানের যৌক্তিকতা তুলে ধরতে চালানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন চারজন কূটনৈতিক কর্মকর্তা।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার এক ভাষণে মোদি সরাসরি পাকিস্তানের নাম না নিলেও সন্ত্রাসী আস্তানাগুলো ধ্বংস করার এবং সন্ত্রাসীদের কঠোর শাস্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
এদিকে দুই দেশের সীমান্তবর্তী নিয়ন্ত্রণরেখায় টানা কয়েকদিন গোলাগুলির ঘটয়ান ঘটেছে।
অনেকে বলেছেন, গত চার রাত ধরেই গোলাগুলি হয়েছে। অন্যদিকে কাশ্মীরে নিরাপত্তা বাহিনী ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করেছে এবং সন্ত্রাসী হামলার সাথে জড়িতদের সন্ধানে ব্যাপক অভিযান চালাচ্ছে। সেখানে শত শত মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ভারতের অন্য শহরগুলোতে পড়াশোনা করা কাশ্মীরী শিক্ষার্থীরা ব্যাপক হয়রানির মুখে পড়ছেন এবং অনেকেই বাধ্য হয়ে বাড়ি ফিরে আসছেন।
এছাড়া পাকিস্তানের দিকে বয়ে যাওয়া নদীগুলোর পানিপ্রবাহ বন্ধ করার ঘোষণা দেয় ভারত। সেই সঙ্গে পাকিস্তানি দূতাবাসের কিছু কর্মী ও ভারতে সফররত পাকিস্তানি নাগরিকদের দেশত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়।
পাকিস্তানও পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ভারতের সাথে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিগুলো বিশেষ করে কাশ্মীর সীমান্তে নিয়ন্ত্রণরেখায় (এলওসি) যুদ্ধবিরতির চুক্তি স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে।
এদিকে হামলার পাঁচ দিন পরও ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে হামলার সঙ্গে জড়িত কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর নাম ঘোষণা করেনি। এই হামলার সঙ্গে পাকিস্তানের জড়িত থাকার পক্ষে খুব কম প্রমাণ এখন পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে। অন্যদিকে পাকিস্তান সরকার এই হামলায় নিজেদের জড়িত থাকার অভিযোগ সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করেছে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কূটনৈতিক ব্রিফিংয়ে কর্মকর্তারা পাকিস্তানের অতীতের সন্ত্রাসবাদে সহায়তার ইতিহাস তুলে ধরেছেন।
তারা জানান, সর্বশেষ এই হামলার ঘটনায় তদন্ত চলছে এবং হামলাকারীদের পাকিস্তানের সঙ্গে সংযোগ রয়েছে এমন কিছু প্রযুক্তিগত তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে।
বিশ্লেষক ও কূটনীতিকদের মতে, এখন পর্যন্ত শক্ত প্রমাণের অভাব দুটি সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়। তা হলো-হয় ভারত আরও তথ্য সংগ্রহের জন্য সময় নিচ্ছে, না হলে বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে তারা মনে করছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বিস্তারিত ব্যাখ্যা না দিয়েই সামরিক পদক্ষেপ নেওয়া যাবে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই পরমাণু শক্তিধর দেশ হওয়ায় সামরিক সংঘাত দ্রুত বড় ধরনের বিপর্যয়ে রূপ নিতে পারে। তবে বর্তমানে ভারতের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশটি আন্তর্জাতিক চাপের তোয়াক্কা করছে না।
ইরান ও সৌদি আরব ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইতোমধ্যে সংঘাত এড়ানোর জন্য মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছেন। জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন উভয়েই সংযম ও সংলাপের আহ্বান জানিয়েছে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রসহ বড় শক্তিধর দেশগুলো এখন অন্য সংকট নিয়ে ব্যস্ত। ফলে ভারত অনেক দেশ থেকে সমর্থন পাওয়াকে ইচ্ছামতো ব্যবস্থা নেওয়ার ইঙ্গিত হিসেবে দেখছে।
যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে ভারতের সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান পরিস্থিতিতে কতটা সক্রিয়ভাবে ভূমিকা রাখবে, তা স্পষ্ট নয়।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম তিন মাস পার হয়ে গেলেও এখনও ভারতে কোনও মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দেওয়া হয়নি। আর এটি ট্রাম্প প্রশাসনের অগ্রাধিকারের তালিকায় যে দক্ষিণ এশিয়া নেই সেটিরই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র বা অন্যান্য শক্তিধর দেশ এই সংঘাতে নিজেদের সংযুক্ত করার চেষ্টা করে, তবুও তাদের প্রভাব তেমন থাকবে না। কারণ ভারত ও পাকিস্তান কাশ্মীর নিয়ে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ করেছে। আর এই বিরোধটিকে দ্বিপাক্ষিক সমস্যা হিসেবে দাবি করে থাকে ভারত।
আমেরিকার জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটি স্কুল অব অ্যাডভান্সড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো ড্যানিয়েল মার্কি বলেন, ২০১৯ সালে কাশ্মীর নিয়ে শেষ বড় ধরনের উত্তেজনার সময় ট্রাম্প যেমন প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন এবারও তেমনই ছিল।
ওই বছর পুলওয়ামায় হামলা ৪০ ভারতীয় জওয়ান নিহত হন। তখন অবশ্য জইশ-ই-মুহাম্মদ নামের পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসী সংগঠনের জড়িত থাকার বিষয়টি স্পষ্ট ছিল।
সে সময় ভারত সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানে বিমান হামলা চালায় এবং পরে পাকিস্তান পাল্টা হামলা চালিয়ে একটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে। পরে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ভারতীয় ওই পাইলটকে আটক করে।
বিশ্লেষকদের মতে, এবার ভারত আরও বড় ধরনের কিছু করার পরিকল্পনা করছে। তবে পাকিস্তানও পাল্টা জবাব দেওয়ার হুমকি দিয়ে রেখেছে।
বিশ্লেষক ড্যানিয়েল মার্কির মতে, উভয় পক্ষই নিজেদের সংকট সামলানোর সক্ষমতা অতিরঞ্জিত করে দেখছে। ফলে পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
এদিকে ২০১৯ সালের ঘটনার তুলনায় এবার হামলাকারী দলের পরিচয় ও সংখ্যা নিয়েও যথেষ্ট অনিশ্চয়তা রয়েছে। রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট নামে কার্যত এক অজ্ঞাত গোষ্ঠী হামলার দায় স্বীকার করেছে। তবে ভারতীয় কর্মকর্তাদের অনানুষ্ঠানিক দাবি, এটি আসলে পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-ই-তৈয়বার ছায়া সংগঠন।
ভারতের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিব শঙ্কর মেনন জানিয়েছেন, মোদি সরকারের জন্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নেওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। কারণ ২০১৬ এবং ২০১৯ সালে কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার পর পাকিস্তানে বিমান হামলা চালিয়েছিল ভারত। এবারের হামলার পর মোদি সরকার এখন চাপের মধ্যে রয়েছে। কারণ তারা কাশ্মীরকে সম্প্রতি আরও নিরাপদ এবং পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় একটি জায়গা হিসেবে উপস্থাপন করছিল। অথচ সেখানে বড় ধরনের নিরাপত্তা ত্রুটি দেখা দিল।
বাংলাফ্লো/এসএস
Comments 0