Logo

খাদ্য গুদাম থেকে তিতুমীর কলেজ: গৌরবের পথচলার ৫৭ বছর

ঔপনিবেশিক শক্তির নীলনকশা ভেস্তে দিয়ে এই নবীন প্রতিষ্ঠান জন্মলগ্ন থেকেই ছাত্র আন্দোলনের এক উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হয়।

ছবি: সংগৃহীত

আরিফুল ইসলাম

ঢাকা: বাংলাদেশের শিক্ষা অঙ্গনে একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম — সরকারি তিতুমীর কলেজ।

রাজধানীর হৃৎস্পন্দন মহাখালীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা সরকারি তিতুমীর কলেজ কেবল একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, এটি বাঙালির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এক জীবন্ত দলিল।

প্রায় ৩৫ হাজার শিক্ষার্থীর পদচারণায় মুখরিত এই বিদ্যানিকেতন দেশের বৃহত্তম কলেজ হিসেবে স্বমহিমায় ভাস্বর।

তিতুমীরের মতো এক বীর স্বাধীনতা সংগ্রামীর নামে এই প্রতিষ্ঠানের নামকরণ যেন আমাদের গৌরবময় অতীতকে সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করিয়ে দেয়।

১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কলেজটি শুরুর পথচলা থেকেই যেন জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের গৌরবময় ইতিহাসের সঙ্গে।

মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গেও এই কলেজের রয়েছে এক গভীর ও অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক।

দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে এই কলেজের তরুণ শিক্ষার্থীরা মাতৃভূমির জন্য অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। স্বাধিকার আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি ক্রান্তিকালে এই কলেজের ছাত্ররা রেখেছে নির্ভীক ও সংগ্রামী ভূমিকা।

যেখানে একসময় ছিল গুদামঘর, সেখানেই আজ উচ্চশিক্ষার দীপ্ত বাতিঘর—তিতুমীর কলেজ

তবে অনেকেই হয়তোবা জানে না তিতুমীর কলেজের বর্তমান সুদৃঢ় ভিত্তির পেছনে রয়েছে এক চমকপ্রদ ইতিহাস। কালের বিবর্তনে বিস্ময়কর পরিবর্তন এসেছে এই প্রতিষ্ঠানের।

পাকিস্তান শাসনামলে এই প্রাঙ্গণ ছিল নিতান্তই এক খাদ্য গুদাম। যেখানে স্তুপ করা থাকতো পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের জীবনধারণের রসদ।

১৯৬৮ সালের আজকের এই দিনে অর্থাৎ ৭ মে জগন্নাথ কলেজের ছাত্রদের আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। সেই আন্দোলনে তিতুমীর কলেজের (বর্তমান নাম) তারুণ্যের বিপ্লবী কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করার জন্য তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান মহাখালীর সেই ডিআইটি খাদ্য গুদামে জগন্নাথ কলেজের ডিগ্রি শাখাকে স্থানান্তরিত করে এক নতুন কলেজের জন্ম দেন।

উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে আন্দোলনের তেজ প্রশমিত করা।

নবগঠিত এই কলেজের নাম রাখা হয় ‘জিন্নাহ কলেজ’।

কিন্তু ঔপনিবেশিক শক্তির নীলনকশা ভেস্তে দিয়ে এই নবীন প্রতিষ্ঠান জন্মলগ্ন থেকেই ছাত্র আন্দোলনের এক উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হয়।

১৯৭১ সালের পহেলা মার্চ, যখন বেতার ও টেলিভিশনের মাধ্যমে পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদ স্থগিত করার ঘোষণা করেন, তখন জিন্নাহ কলেজ ছাত্র সংসদের প্রথম ভিপি ছিলেন সিরাজউদ্দৌলা, যিনি পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন।

তৎক্ষণাৎ তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, শাহাবুদ্দিনসহ কয়েকজন তেজস্বী ছাত্রনেতা জিন্নাহ্ কলেজের সাইনবোর্ড ভেঙে ফেলেন।

বর্তমান বিজ্ঞান ভবনের সম্মুখে সকলে মিলে নতুন নামকরণের প্রস্তাবনা করেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা কামাল উদ্দিন আহমেদ ‘মাস্টার দা সূর্যসেন’-এর নাম প্রস্তাব করলে, সেই সময়ে জিন্নাহ কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক আনিসুজ্জামান খোকন ‘তিতুমীর কলেজ’ নামটি উত্থাপন করেন।

পরদিন কলেজের শিক্ষার্থীরা মিছিল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় তৎকালীন ডাকসু ভিপি আ স ম আবদুর রবের কাছে যান, এবং তিনি জিন্নাহ্ কলেজের নাম ‘তিতুমীর কলেজ’ হিসেবে চূড়ান্ত করেন।

সেই রাতেই কারফিউ উপেক্ষা করে টিপু মুনশীর বন্ধু সুজিতের রং-তুলির আঁচড়ে কলেজের সাইনবোর্ডে লেখা হয় ‘তিতুমীর কলেজ’। তখনই সেনাবাহিনীর ধাওয়া খেয়ে উপস্থিত সকলে দেয়াল টপকে পালাতে বাধ্য হন।

অতীতের গর্ব, বর্তমানের শক্তি—তিতুমীর কলেজ এগিয়ে চলেছে আলোর পথে

সূচনালগ্নে তিতুমীর কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা কার্যক্রম চালু থাকলেও, পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করে এবং ক্রমবর্ধমান চাহিদার প্রেক্ষিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়ে এখানে কেবল স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণিসমূহের পাঠদান শুরু হয়।

শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন এবং শিক্ষার্থীদের জন্য আরও উন্নত শিক্ষাদানের সুযোগ তৈরির অভিপ্রায়ে ২০১৭ সালে এই কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়।

তবে পূর্বের সকল বিভাগ তখনও স্ব-মহিমায় তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল।

বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে তিনটি অনুষদের ২৩টি বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরের শিক্ষা কার্যক্রম সাফল্যের সঙ্গে চলছে।

সুবিশাল ক্যাম্পাস জুড়ে রয়েছে একাধিক অ্যাকাডেমিক ভবন, পাঁচটি আবাসিক হল, শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য নয়টি বাস এবং কয়েক হাজার মূল্যবান গ্রন্থের সমৃদ্ধ এক গ্রন্থাগার। এছাড়াও জ্ঞানপিপাসু শিক্ষার্থীদের জ্ঞানার্জন এবং বিভিন্ন দক্ষতা অর্জনের জন্য রয়েছে একাধিক ছাত্র সংগঠন, সহশিক্ষা কার্যক্রম ও সাংস্কৃতিক সংঘ।

তিতুমীর কলেজ: শুধু প্রতিষ্ঠান নয়, নেতৃত্ব গড়ার পাঠশালা

সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, বীর মুক্তিযোদ্ধা কামাল উদ্দিন আহমেদ, সাবেক সংসদ সদস্য এম এম শাহীন, প্রখ্যাত গীতিকার ও সাংবাদিক রবিউল ইসলাম জীবন, জনপ্রিয় অভিনেতা শতাব্দী ওয়াদুদ, হাসান মাসুদ, জিয়াউল হক পলাশ, ও শবনম বুবলীর মতো বহু কৃতী ব্যক্তিত্বের শিক্ষাজীবনের স্বর্ণালী অধ্যায় এই সরকারি তিতুমীর কলেজের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত।

এছাড়াও এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা আলো ছড়াচ্ছেন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে সফলতার সঙ্গে।

গৌরবের অতীত, আলোকিত ভবিষ্যৎ—প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এক নতুন প্রত্যয়

ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এই অমূল্য ধারক তিতুমীর কলেজকে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের জন্য এখানকার শিক্ষার্থীরা নিরলসভাবে আন্দোলন, সংগ্রাম ও বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে চলেছে।

সরকারিভাবে সাতটি কলেজ মিলে একটি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া চলমান থাকলেও, শিক্ষার মানোন্নয়নের স্বার্থে শিক্ষার্থীরা তিতুমীর কলেজকে একক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে দেখার স্বপ্ন দেখেন।

তবে শিক্ষার্থী সংখ্যার বিচারে দেশের বৃহত্তম এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি শেষ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করবে কিনা, তা নিয়ে জনমনে এখনও প্রশ্ন বিদ্যমান।

দীর্ঘ পথ পেরিয়ে আজও অটল প্রতিষ্ঠানটি উদযাপন করছে তার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ইতিহাস, অর্জন আর স্বপ্নের মিশেলে আজকের এই দিনটি শুধু একটি তারিখ নয় — এক গৌরবের নাম।

এই দিনটি কলেজের শিক্ষার্থীদের কাছে শুধু উৎসব নয়। বরং নতুন করে স্বপ্ন দেখার এক অনন্য উপলক্ষ — যেখানে অতীতের গৌরব আর ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি একসাথে মেলে।

বাংলাফ্লো/এসবি

Related Posts শিক্ষা

Leave a Comment

Comments 0