মঙ্গলবার, ২১ অক্টোবর ২০২৫

‘নজরদারির জন্য ফ্যাসিস্ট আ লীগ সরকার ২২শ কোটি টাকার সরঞ্জাম কিনেছিল’

অনুসন্ধানী প্রতিষ্ঠান আরও জানিয়, এসব প্রযুক্তি প্রায়শই অস্বচ্ছ ক্রয় প্রক্রিয়া এবং তৃতীয় দেশের মধ্যস্থতায় আনা হয়েছে।

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাফ্লো প্রতিনিধি,

ঢাকা: বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১৫ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে প্রায় ১৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২,২৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৬০টিরও বেশি নজরদারি প্রযুক্তি এবং স্পাইওয়্যার আমদানি করা হয়েছে। সাম্প্রতিক এমন তথ্য উঠে এসেছে ‘টেকনোগ্লোবাল ইনস্টিটিউট’ এর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এই সাইবার নজরদারি বিরোধী রাজনীতিক, সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্ট এবং সাধারণ নাগরিকদের লক্ষ্য করে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, বিশেষ করে নির্বাচনের সময় এবং গণবিক্ষোভের সময়।

অনুসন্ধানী প্রতিষ্ঠান আরও জানিয়, এসব প্রযুক্তি প্রায়শই অস্বচ্ছ ক্রয় প্রক্রিয়া এবং তৃতীয় দেশের মধ্যস্থতায় আনা হয়েছে।

এক বছর ধরে চলা গবেষণার ভিত্তিতে তৈরি ৭০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ৯/১১ সন্ত্রাসী হামলা এবং ২০১৬ সালে ঢাকার হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর সন্ত্রাস দমনের অজুহাতে এই নজরদারির বিস্তার ঘটে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গত এক দশকে বাংলাদেশের নজরদারি ব্যবস্থা ঔপনিবেশিক আমলের পুলিশিং ঐতিহ্য থেকে আধুনিক সাইবার-ভিত্তিক নেটওয়ার্কে রূপান্তরিত হয়েছে।

বাংলাদেশ যে ধরনের প্রযুক্তি আমদানি করেছে তার মধ্যে রয়েছে আইএমএসআই ক্যাচার, ওয়াই-ফাই ইন্টারসেপ্টর অ্যান্ড সেলিব্রাইট, ফিনফিশার, প্রিডেটর-এর মতো উন্নত স্পাইওয়্যার। এসব প্রযুক্তি বিস্তৃত এবং প্রায়শই পরোয়ানা ছাড়া নজরদারি চালানোর সুযোগ করে দেয়।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এই ১৯০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ের মধ্যে কমপক্ষে ৪০ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে ইসরায়েলি-উৎস থেকে আসা প্রযুক্তিগুলোর জন্য। এই প্রযুক্তিগুলোর বেশিরভাগই বিশ্বের অন্যান্য দেশের স্বৈরাচারী শাসকরাও ব্যবহার করছেন।

র‍্যাব ও পুলিশ ওয়াই-ফাই ও মোবাইল নেটওয়ার্ক ইন্টারসেপশন, সিগন্যাল জ্যামিং এবং বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষভাবে তৈরি প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করেছে।

এছাড়া তৎকালীন সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা প্রাথমিকভাবে সেল নেটওয়ার্ক পর্যবেক্ষণ, ট্যাপ করা এবং সিগন্যাল জ্যামিংয়ের জন্য অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করেছে। ২০১৫ সালে তারা সিটিজেন ল্যাব থেকে ফিনফিশার নামের একটি কম্পিউটার স্পাইওয়্যার কিনেছিল, যা ডিভাইসে ম্যালওয়্যার ইনস্টল করে ডেটা চুরি করতে পারে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের কাছে নজরদারি প্রযুক্তি বিক্রি করেছে। সবচেয়ে সমালোচিত বিষয় হলো, ইসরায়েলের সঙ্গে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও সেলেব্রাইট (Cellebrite), এনএসএ গ্রুপ (পেগাসাস), ইনটেলেক্সা, কোরালকো টেক এবং ইউটিএক্স টেকনোলজিস-এর মতো ইসরায়েলি কোম্পানিগুলোর তৈরি প্রযুক্তি সাইপ্রাস, সিঙ্গাপুর ও হাঙ্গেরির মতো তৃতীয় দেশের মাধ্যমে বাংলাদেশে আনা হয়েছে। এছাড়াও তুরস্কের স্পাইওয়্যার ফার্ম বিলগি টেকনোলজি টাসারিম (Bilgi Teknoloji Tasarim-BTT)-ও বাংলাদেশের কাছে নজরদারি সরঞ্জাম বিক্রি করেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নজরদারি ব্যবস্থার এই বিস্তারের পেছনে রয়েছে আইনি দুর্বলতা। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০১, টেলিগ্রাফ আইন, ১৮৮৫ এবং ওয়্যারলেস টেলিগ্রাফি আইন, ১৯৩৩-এর মতো পুরোনো আইনগুলোকে এমনভাবে ব্যবহার করা হয়, যা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে ব্যাপক নজরদারির ক্ষমতা দেয়।

এই নজরদারি কার্যক্রমে কোনও সংসদীয় তদারকি, বিচারিক সম্পৃক্ততা বা জবাবদিহিতার ব্যবস্থা নেই। ফলে, রাষ্ট্রীয় নজরদারি ব্যবস্থা জনগণের সুরক্ষার পরিবর্তে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ এবং ভিন্নমত দমনের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।

প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে নজরদারি প্রযুক্তির ক্রয় নাটকীয়ভাবে বেড়েছিল, যা ইঙ্গিত দেয় যে, এই প্রযুক্তিগুলো রাজনৈতিক ও নাগরিক আন্দোলন দমনে ব্যবহৃত হয়েছে।

এই পদ্ধতিগত সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য প্রতিবেদনে আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের সুপারিশ করা হয়েছে। যদি এই ধরনের সংস্কার না করা হয়, তবে দেশটিতে ডিজিটাল স্বৈরাচারী শাসনের মডেল আরও শক্তিশালী হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে, যেখানে নজরদারি জনগণের স্বার্থ বা নিরাপত্তার বদলে রাজনৈতিক ক্ষমতার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে।

সূত্র: টেকনোগ্লোবাল ইনস্টিটিউট

বাংলাফ্লো/এনআর

Leave a Comment

Comments 0