Logo

যে পুতুল বদলে দিয়েছিল ধাত্রীবিদ্যার ইতিহাস ও হাজারো মায়ের ভাগ্য

এই কৃত্রিম জরায়ুতে থাকতো একটি পুতুল, যার মাথা ঘোরানো যেত, মুখে জিহ্বা ছিল, এমনকি চুলও আঁকা ছিল কালি দিয়ে! বিভিন্ন দড়ি ও স্ট্র্যাপের মাধ্যমে তিনি ডেলিভারির সময়কার বাস্তব পরিস্থিতি তৈরি করে দেখাতেন।

ছবি: সংগৃহীত

টেকনোলজি ডেস্ক

ঢাকা: আজ থেকে প্রায় ২৬০ বছর আগের কথা। সময়টা তখন ১৭৬০ সাল। এক ভয়াবহ দুঃসময় চলছে ফ্রান্সে তখন। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মা\রা যাচ্ছেন হাজার হাজার মা ও শিশু। চিকিৎসা ব্যবস্থা অনুন্নত, নেই কোনো স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই। প্রসব যেন ছিল মৃ\ত্যু\র সাথে পাঞ্জা লড়া।

এই ঘোর অন্ধকারের মাঝে একাই আলোর মশাল নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন এক অদম্য নারী—আঞ্জেলিক মার্গারিট ল্য বুরসিয়ে দু কুদ্রে। তিনি ছিলেন একজন ধাত্রী, কিন্তু শুধু সন্তান প্রসব করানোই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল না। তিনি চেয়েছিলেন এমন এক ব্যবস্থা তৈরি করতে, যা অগণিত মায়ের জীবন বাঁচাবে। এবং তিনি তা পেরেছিলেন!

নিজের মেধা আর সৃজনশীলতা দিয়ে তিনি তৈরি করেছিলেন এক অবিশ্বাস্য জিনিস—কাপড়, চামড়া আর তুলা দিয়ে বানানো একটি পূর্ণাঙ্গ নারীদেহ ও জরায়ুর মডেল!

এটি ছিল পৃথিবীর প্রথম ধাত্রীবিদ্যার হাতে-কলমে শিক্ষার মডেল, যা পরিচিত ছিল “দ্য মেশিন” (The Machine) নামে। এই কৃত্রিম জরায়ুতে থাকতো একটি পুতুল, যার মাথা ঘোরানো যেত, মুখে জিহ্বা ছিল, এমনকি চুলও আঁকা ছিল কালি দিয়ে! বিভিন্ন দড়ি ও স্ট্র্যাপের মাধ্যমে তিনি ডেলিভারির সময়কার বাস্তব পরিস্থিতি তৈরি করে দেখাতেন। ছাত্রছাত্রীরা এই মডেলে নিজের হাতে অনুশীলন করে শিখতো কীভাবে নিরাপদে একটি শিশুকে পৃথিবীর আলো দেখাতে হয়।

ফ্রান্সের রাজা পঞ্চদশ লুই যখন গ্রামের পর গ্রামজুড়ে মাতৃমৃত্যুর হাহাকারে অতিষ্ঠ, তখন তিনি আঞ্জেলিক দু কুদ্রের উপর এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব দেন। পরবর্তী ২৫ বছর ধরে এই মহীয়সী নারী একটি ঘোড়ার গাড়িতে করে তাঁর এই কাপড়ের জরায়ু নিয়ে চষে বেড়িয়েছেন ফ্রান্সের এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে। তিনি প্রায় ৪,০০০ এর বেশি ছাত্রছাত্রীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন, যাদের অধিকাংশই ছিলেন গ্রামের সাধারণ নারী, যাদের এর আগে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই ছিল না।

শুধু তাই নয়, ১৭৭৩ সালে তিনি প্রকাশ করেন তাঁর যুগান্তকারী বই প্রসববিদ্যার সারসংক্ষেপ, যা ধাত্রীবিদ্যাকে এক নতুন বৈজ্ঞানিক রূপ দেয়। তাঁর এই অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে ফ্রান্সের অনেক অঞ্চলের মাতৃমৃত্যুর হার নাটকীয়ভাবে কমে আসে।

ইতিহাসের পাতায় প্রায় হারিয়ে যাওয়া আঞ্জেলিক দু কুদ্রে কেবল একজন ধাত্রী ছিলেন না; তিনি ছিলেন একজন যুগান্তকারী উদ্ভাবক, একজন স্বপ্নদ্রষ্টা শিক্ষক এবং নারীস্বাস্থ্যের এক অকুতোভয় সৈনিক। তাঁর সাহস, মায়া আর অসামান্য উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে তিনি ভয়কে শক্তিতে রূপান্তরিত করেছিলেন এবং বাঁচিয়েছিলেন অগণিত প্রাণ।

যে যুগে নারীদের ঘরের বাইরে পা ফেলাই কঠিন ছিল, সেই যুগে একজন নারী কীভাবে একাই পুরো একটা বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন!

তথ্যসূত্র:

1. Wikipedia: Angélique du Coudray

2. Journal of Medical Education and Curricular Development: \La Machine: Obstetric

3. Phantoms of Madame Du Coudray … Back to the Roots\

4. JSTOR Daily: “How a French Midwife Solved a Public Health Crisis”

5. Musée Flaubert et d'histoire de la médecine, Rouen, France (যেখানে তাঁর তৈরি করা একটি মডেল সংরক্ষিত আছে)

বাংলাফ্লো/আফি

Post Reaction

👍

Like

👎

Dislike

😍

Love

😡

Angry

😭

Sad

😂

Funny

😱

Wow

Leave a Comment

Comments 0