শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

নেপাল ও বাংলাদেশের সরকার পতনে মিল-অমিল

ঠিক এক বছর এক মাসের ব্যবধানে প্রথমে বাংলাদেশ, আর তারপর নেপালের নাটকীয় রাজনৈতিক পটপরিবর্তন শুধু দক্ষিণ এশিয়ার নয়– সামগ্রিক ভূরাজনীতিতেই একটা প্রবল আলোড়ন ফেলেছে।

সংগৃহীত

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

ঢাকা: ঠিক এক বছর এক মাসের ব্যবধানে প্রথমে বাংলাদেশ, আর তারপর নেপালের নাটকীয় রাজনৈতিক পটপরিবর্তন শুধু দক্ষিণ এশিয়ার নয়– সামগ্রিক ভূরাজনীতিতেই একটা প্রবল আলোড়ন ফেলেছে। ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশে সংঘটিত আন্দোলনের জেরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যেমন দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়েছিল, অনেকটা সেভাবেই চলতি সেপ্টেম্বরে নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি দেশ ছাড়তে বাধ্য হলেন।

দক্ষিণ এশিয়ার এই দুটো ঘটনায় অনেক সাদৃশ্য আছে। আবার অনেক পার্থক্য থাকার বিষয়টিও মনে করিয়ে দিচ্ছেন পর্যবেক্ষকরা। এই মিল আর অমিলগুলো ঠিক কোথায়, সে দিকেই নজর দেওয়া যাক।

শুরুতে ‘উপলক্ষ’টা ছিল অন্য

বাংলাদেশে আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে। পরে তা সরকার পতনের ‘এক দফা, এক দাবি’তে রূপ নেয় এবং তখনকার ক্ষমতাসীন সরকার বিদায় নিতে বাধ্য হয়।

নেপালে দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন চললেও তা ব্যাপক আকার ধারণ করে ২৬টি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম নিষিদ্ধ করার সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধিতার মধ্যে দিয়ে। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেই গত ৮ সেপ্টেম্বর নেপালের ‘জেন জি’-রা যে জমায়েতের ডাক দিয়েছিল, সেটাই পরে সরকারের পতন ডেকে আনে। ওই বিক্ষোভে অংশ নেওয়া অনেকেই সেদিন বলেছিলেন, শুধু সোশ্যাল মিডিয়ার ইস্যুতে নয়– তারা এসেছেন দেশের নেতা-মন্ত্রীদের সর্বগ্রাসী দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং তরুণদের কর্মসংস্থানের দাবিতে।

পুলিশ ও নিরাপত্তাবাহিনীর নির্বিচার গুলি চালনা

বাংলাদেশে আন্দোলনের মোড় ঘুরে যায় যখন জুলাই মাসের মাঝামাঝি পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর দিক থেকে আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালনা শুরু হয়। ওদিকে নেপালেও গত ৮ সেপ্টেম্বর কারফিউ ভেঙে পার্লামেন্টের দিকে এগিয়ে যাওয়া বিক্ষোভকারীদের ওপর যখন নিরাপত্তা বাহিনী প্রাণঘাতী অস্ত্র প্রয়োগ করে এবং তাতে পঁচিশ জনের মতো নিহত হন, ঠিক তখন থেকেই আন্দোলন সম্পূর্ণ ভিন্ন দিকে মোড় নেয়।

সরকারপ্রধানের দেশত্যাগ

বাংলাদেশে গত বছরের ৫ অগাস্ট গণভবনের নিকটবর্তী হেলিপ্যাড থেকে সামরিক হেলিকপ্টারে করে দেশ ছাড়েন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নেপালেও প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি ঠিক একইভাবে হেলিকপ্টারে চেপেই কাঠমান্ডু ছেড়েছেন গত ৯ সেপ্টেম্বর। তবে শেখ হাসিনা শেষ পর্যন্ত ভারতের মাটিতে গেলেও ওলি ঠিক কোথায় গিয়েছেন তা এখনও স্পষ্ট নয়। কেউ বলছেন তিনি দুবাইয়ে পাড়ি দিয়েছেন, কেউ আবার বলছেন তিনি নেপালের ভেতরেই আত্মগোপনে আছেন।

আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ মিল হলো, উভয় ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট দেশের রাষ্ট্রপ্রধান জানিয়েছেন, সরকারপ্রধান বিদায় নেওয়ার আগে পদত্যাগ করে গেছেন। ফলে সরকারও তখনই ভেঙে গেছে।

সেনাবাহিনীর ভূমিকা

বাংলাদেশ বা নেপাল, কোনও দেশেই টালমাটাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশের সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা দখলের উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। বরং দুই দেশের বাহিনীই একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়। বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান ৫ অগাস্ট বিকেলেই আওয়ামী লীগ ছাড়া বাকি সব দলকে নিয়ে সর্বদলীয় বৈঠক করেন। তাছাড়া দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীকেই নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নেওয়ার কাজটিও করেছে সেনাবাহিনী।

বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের যে সব নেতাকর্মীর ওপর হামলার আশঙ্কা ছিল, তাদের অনেককেই যে সপরিবারে ক্যান্টনমেন্টগুলোতে আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল, তা সেনাবাহিনী পরে নিজেই জানিয়েছে।নেপালেও রাজনীতিবিদদের ওপর নৃশংস হামলা শুরু হওয়ার পর সেনাবাহিনী তাদের অনেককেই বাঁচাতে এগিয়ে এসেছে বলেও জানা যাচ্ছে।

আড়াই দিনে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন

শেখ হাসিনার বিদায়ের ঠিক তিন দিনের মাথায় ৮ অগাস্ট সন্ধ্যায় প্যারিস থেকে ফিরে বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। নেপালেও প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি পদত্যাগ করেন ৯ সেপ্টেম্বর, আর ১২ সেপ্টেম্বর রাতেই নেপালের অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন সুশীলা কার্কি। অদ্ভুতভাবে দুই দেশেই এই দুটো ঘটনার মধ্যে ব্যবধান ছিল ঠিক আড়াই দিনের।

বাংলাদেশে আন্দোলনকারীদের তরফ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ড. ইউনূসকে পছন্দ করা হয়েছিল, ঠিক সেভাবেই নেপালের ‘জেন জি’দের প্রস্তাব ছিল সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কি। দুক্ষেত্রেই তাদের আপাত পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি তরুণদের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্য করেছে।

কথিত ‘ডিপ স্টেটে’র ভূমিকা

বাংলাদেশের ক্ষমতার পালাবদলে মার্কিন ‘ডিপ স্টেট’ এবং অন্যান্য বৈদেশিক কুশীলবদের কলকাঠি নাড়ার বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা রয়েছে। একই ধরনের কথাবার্তা এখন শোনা যাচ্ছে নেপালের আন্দোলন নিয়েও। কে এই বিক্ষোভকারীদের মদত দিয়েছে, কারা টাকাপয়সা জুগিয়েছে, কোন বিদেশি শক্তির স্বার্থ এরা হাসিল করছে – এরকম বিভিন্ন প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। তবে কোনও ক্ষেত্রেই ‘ডিপ স্টেটে’র যোগসাজশ নিয়ে অকাট্য বাহ্যিক প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি।

সহিংসতার মাত্রা

বাংলাদেশে সরকারের পতনের পর বেশ কিছুটা সময় দেশে আইন-শৃঙ্খলা বলতে কার্যত কিছু ছিল না। তার একটা বড় কারণ ছিল দেশের পুলিশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল, একের পর এক থানা ছেড়ে পুলিশ সদস্যরা পালিয়ে গিয়েছিলেন। আর নেপালে মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) থেকেই যেভাবে সাবেক ও বর্তমান নেতা-মন্ত্রীদের ওপর হামলা শুরু হয়েছে, তার বীভৎসতা সবাইকে চমকে দিয়েছে। একজন মন্ত্রীকে বিবস্ত্র করে রাস্তা দিয়ে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, বাড়িতে আগুন দেওয়ায় জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী। কাঠমান্ডুতে হিল্টন ও হায়াতের মতো বিলাসবহুল হোটেল জ্বালিয়ে ছাই করে দেওয়া হয়েছে, অবাধে লুঠতরাজ চালানো হয়েছে বহু বিপণিতে। অভ্যুত্থানের পরে সহিংসতা ও আরাজকতার মাত্রা কোথায় বেশি ছিল তার তুলনা হয়তো সম্ভব নয়– কিন্তু নেপাল ও বাংলাদেশ দুটো দেশের মানুষই প্রায় একই বর্বরতা দেখিয়েছে।

দুই দেশের পরিস্থিতিতে প্রধান অমিল যেখানে

এ বিষয়ে পর্যবেক্ষকদের মধ্যে বিভিন্ন রকম মত আছে। বাংলা ট্রিবিউন এই প্রশ্নটিই রেখেছিল সাবেক ভারতীয় কূটনীতিবিদ দেব মুখার্জির কাছে। সুদীর্ঘ ক্যারিয়ারে বাংলাদেশ ও নেপাল দুদেশেই ভারতের হাই কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।

দেব মুখার্জি বলছিলেন, আপাতদৃষ্টিতে দুই দেশের অভ্যুত্থানে অনেক মিল থাকলেও একটু তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে পার্থক্যও অনেক আছে। বস্তুত বাহ্যিক দৃষ্টিতে বেশ কিছু মিল থাকলেও মৌলিক পার্থক্যটাই বেশি বলে আমার বিশ্বাস। আর প্রধান পার্থক্য হল – বাংলাদেশ সংবিধান এখনও সুরক্ষিত থাকলেও নেপালে তা হবে কি না, আমি নিশ্চিত নই একেবারেই!

তার ধারণা, বাংলাদেশে গত এক বছরে সংবিধান সংস্কার, এমনকি বাহাত্তরের সংবিধান পুরোপুরি বাতিল করারও দাবি উঠেছে। কিন্তু এরপরও মূল অসাম্প্রদায়িক চরিত্র নিয়ে সংবিধানটি টিকে যেতে পারে।

তবে নেপালের ক্ষেত্রে অতোটা আশাবাদী হতে পারছেন না মুখার্জি। তিনি বলেন, সে দেশে আন্দোলনকারীরা ২০১৫'র সংবিধান বাতিল করার জোরালো দাবি তুলছেন। সেটা বাস্তবে পরিণত হলে নেপালের বহু বছরের পরিশ্রম, সংগ্রাম ও আন্দোলনই শুধু জলে যাবে না– সে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র, নাগরিকদের মৌলিক অধিকার, সামাজিক ন্যায় ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি অঙ্গীকারও বিপন্ন হবে। এমন কি রাজতন্ত্র ফেরানোর দাবিও হয়তো জোরালো হবে।

ক্ষমতার পালাবদলের পর কোনও দেশেই পুরনো সংবিধানের অস্তিত্ত্ব থাকে কি না– সম্ভবত সেই নিরিখেই ইতিহাস শেষ পর্যন্ত দুই দেশের ঘটনাক্রমকে বিচার করবে।

বাংলাফ্লো/এফএ

Post Reaction

👍

Like

👎

Dislike

😍

Love

😡

Angry

😭

Sad

😂

Funny

😱

Wow

Leave a Comment

Comments 0