বুধবার, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

হামাসের নিয়ন্ত্রনের বাইরে গাজার বেশিরভাগ অংশ

হামাসের নিরাপত্তা বাহিনীর এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বিবিসিকে জানিয়েছেন, ফিলিস্তিনের সশস্ত্র সংগঠনটি গাজা উপত্যকার প্রায় ৮০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। শূন্যস্থান দখল করছে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী।

ফাইল ছবি

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

ঢাকা: হামাসের রাজনৈতিক, সামরিক ও নিরাপত্তা কাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে কয়েক মাস ধরে চলা ইসরায়েলি হামলায়। এর ফলে সংগঠনটির নেতৃত্ব ও যোগাযোগব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়েছে।

হামাসের নিরাপত্তা বাহিনীর এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বিবিসিকে জানিয়েছেন, ফিলিস্তিনের সশস্ত্র সংগঠনটি গাজা উপত্যকার প্রায় ৮০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। শূন্যস্থান দখল করছে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদমর্যাদার ওই কর্মকর্তা জানান, কয়েক মাস ধরে চলা ইসরায়েলি হামলায় হামাসের রাজনৈতিক, সামরিক ও নিরাপত্তা কাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে। এর ফলে সংগঠনটির নেতৃত্ব ও যোগাযোগব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়েছে।

তিনি আরও জানান, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের নেতৃত্বাধীন হামলার পর শুরু হওয়া যুদ্ধে প্রথম সপ্তাহেই তিনি আহত হন। এরপর স্বাস্থ্যগত কারণে দায়িত্ব পালন থেকে সরে দাঁড়ান।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বিবিসির সঙ্গে কয়েকটি ভয়েস মেসেজ শেয়ার করেন। সেখানে তিনি বলেন, গাজায় হামাসের নিয়ন্ত্রণ ভেঙে পড়েছে এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রায় পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, 'বাস্তব চিন্তা করলে দেখা যায়, নিরাপত্তা কাঠামোর কিছুই আর বাকি নেই। নেতৃত্বের ৯৫ শতাংশই মারা গেছে… সক্রিয় ব্যক্তিরা সবাই নিহত হয়েছেন। তাহলে এখন ইসরায়েলের এই যুদ্ধ থামাতে বাধা কোথায়?'

তিনি আরও বলেন, 'যুক্তি দিয়ে ভাবলে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। সব পরিস্থিতিই তো তাই বলছে—ইসরায়েলের হাত শক্তিশালী, বিশ্ব চুপ, আরব দেশগুলোও চুপ, অপরাধী দলগুলো চারদিকে, সমাজ ভেঙে পড়ছে।'

গত সেপ্টেম্বরেই ইসরায়েলের তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, 'সামরিক দিক থেকে হামাস আর অস্তিত্বে নেই' এবং তারা এখন গেরিলা কায়দায় লড়ছে।

হামাসের ওই কর্মকর্তা জানান, চলতি বছরের শুরুতে ইসরায়েলের সঙ্গে ৫৭ দিনের যুদ্ধবিরতির সময় হামাস পুনর্গঠনের চেষ্টা করেছিল—রাজনৈতিক, সামরিক ও নিরাপত্তা পরিষদগুলোকে সক্রিয় করতে চেয়েছিল।

কিন্তু মার্চে যুদ্ধবিরতি শেষ হওয়ার পর ইসরায়েল হামাসের বাকি থাকা নেতৃত্বকেই নিশানা করেছে, যার ফলে সংগঠনটি ফের বিশৃঙ্খলায় পড়ে।

তিনি বলেন, 'নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে স্পষ্ট করে বলি—সবকিছুই ভেঙে পড়েছে। পুরোপুরি শেষ। কোথাও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।'

তিনি আরও জানান, হামাসের সবচেয়ে শক্তিশালী নিরাপত্তা বাহিনী 'আনসার'-এর সদর দপ্তর সাধারণ মানুষ লুটপাট করে ফেলেছে।

তিনি বলেন, 'সবকিছু লুট হয়েছে—অফিস, খাট, এমনকি টিনের ছাদও। কেউ কিছু বলেনি। না কোনো পুলিশ এসেছে, না নিরাপত্তা বাহিনী।'

ওই কর্মকর্তা জানান, নিরাপত্তা ব্যবস্থার পতনের ফলে সশস্ত্র গ্যাং বা গোষ্ঠী এখন সবখানে ছড়িয়ে পড়েছে।

তিনি বলেন, 'তারা যেকোনো সময় আপনাকে থামিয়ে হত্যা করতে পারে। কেউ বাধা দেবে না। কেউ যদি নিজে থেকে চুরি-ডাকাতির বিরুদ্ধে কিছু করতে যায়, তাকে ইসরায়েল আধাঘণ্টার মধ্যেই বোমা মেরে ফেলে।'

তিনি আরও বলেন, 'নিরাপত্তা এখন শূন্য। হামাসের নিয়ন্ত্রণ শূন্য। কোনো নেতৃত্ব নেই, কোনো নির্দেশনা নেই, যোগাযোগ নেই। বেতন সময়মতো আসে না, আর এলেও সেটা দিয়ে কিছু হয় না। কেউ কেউ শুধু টাকা তুলতে গিয়ে মারা যায়। সবকিছু একেবারে ধসে পড়েছে।'

২৬ জুন ইসরায়েলের ড্রোন হামলায় অন্তত ১৮ জন নিহত হন। প্রত্যক্ষদর্শী ও চিকিৎসকদের বরাতে জানা যায়, হামলার লক্ষ্য ছিল হামাসের সাদা পোশাকধারী পুলিশ সদস্যরা, যারা দেইর আল-বালাহর এক বাজারে নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তারা দোকানিদের অতিরিক্ত দাম চাওয়া ও ত্রাণ চুরি করে বিক্রির অভিযোগে হস্তক্ষেপ করছিলেন।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানায়, তারা হামাসের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাহিনীর 'সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের' ওপর হামলা চালিয়েছে।

ওই কর্মকর্তা বলেন, গাজায় নিরাপত্তাহীনতার সুযোগে প্রভাবশালী ছয়টি সশস্ত্র গোষ্ঠী বড় শক্তি হয়ে উঠেছে। এদের হাতে টাকা, অস্ত্র ও লোকবল রয়েছে। তারা গাজার সবখানে সক্রিয়, তবে দক্ষিণে বেশি।

তাদের একজন ইয়াসের আবু শাবাব। তিনি এতটাই আলোচনায় এসেছেন যে পশ্চিমতীরে অবস্থানকারী হামাসের প্রতিদ্বন্দ্বী ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ও আঞ্চলিক শক্তিগুলো পর্যন্ত তাকে নজরে রেখেছে। গত মাসে ইসরায়েল নিশ্চিত করেছে, তারা আবু শাবাবকে অস্ত্র দিচ্ছে।

কর্মকর্তাটি জানান, হামাস তার মাথার ওপর বড় অঙ্কের পুরস্কার ঘোষণা করেছে, কারণ আশঙ্কা করা হচ্ছে—তিনি হামাসবিরোধীদের একত্রিত করার নেতা হয়ে উঠতে পারেন।

তিনি বলেন, 'সাধারণ চোর-ডাকাতদের হামাস তেমন গুরুত্ব দিত না—মানুষ তো ক্ষুধার্ত, আর যোদ্ধারা চায় না নতুন বিশৃঙ্খলা তৈরি হোক। কিন্তু এই লোকটা? হামাসের যোদ্ধারা যদি তাকে খুঁজে পায়, তাহলে হয়তো ইসরায়েলি ট্যাংকের চেয়ে তাকেই আগে ধরতে যাবে।'

গাজার একাধিক সূত্র বিবিসিকে জানিয়েছে, আবু শাবাব এখন অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে যৌথ পরিষদ গঠনের চেষ্টা করছেন, যার লক্ষ্য হামাসকে ক্ষমতা থেকে সরানো।

১৯৯৬ সালে হামাসের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো ফিলিস্তিনি নিরাপত্তা বাহিনীর সাবেক এক কর্মকর্তা বলেন, আবু শাবাবের নেটওয়ার্ক ধীরে ধীরে প্রভাব বাড়াচ্ছে।

বর্তমানে কায়রোতে থাকা ওই অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, 'আবু শাবাবের গোষ্ঠী যেন এক অনাথ শিশু—যদি সে হামাসের শাসন দুর্বল করতে পারে, সবাই তাকে দলে নিতে চাইবে।'

তিনি জানান, প্রকাশ্যে কেউ গাজার সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্বীকার না করলেও আবু শাবাব অন্তত তিনবার এক ঊর্ধ্বতন ফিলিস্তিনি গোয়েন্দা কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করেছেন। এছাড়া সিনাইয়ে থাকা আত্মীয়দের মাধ্যমে মিশরীয়দের কাছে শান্তির বার্তাও পাঠিয়েছেন।

তিনি আরও দাবি করেন, আবু শাবাবের সঙ্গে মোহাম্মদ দাহলানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। দাহলান গাজার সাবেক নিরাপত্তা প্রধান; ১৫ বছর আগে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে বিরোধে পড়ে নির্বাসনে যান।

হামাসের নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেন, 'আবু শাবাবকে সরাতে হামাস যেকোনো কিছু করতে পারে। কারণ, সে এখন যতটা না সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী, তার চেয়ে বড় আশঙ্কা হলো—সে যদি হামাস বিরোধীদের প্রতীক হয়ে ওঠে।'

তিনি বলেন, '১৭ বছর ধরে হামাস চারপাশে শত্রু তৈরি করেছে। কেউ যদি সেসব শক্তিকে একত্র করতে পারে, সেটাই আমাদের শেষের শুরু হতে পারে।'

গাজা যখন আরও গভীর বিশৃঙ্খলায় ডুবে যাচ্ছে, পাড়া-মহল্লার নিয়ন্ত্রণ চলে যাচ্ছে সশস্ত্র গোষ্ঠীর হাতে, তখন হামাস ইসরায়েলি হামলার পাশাপাশি ভেতরের প্রতিদ্বন্দ্বীদের ঘেরাওয়ের মুখেও পড়েছে।

সূত্র: বিবিসি

বাংলাফ্লো/আফি

Post Reaction

👍

Like

👎

Dislike

😍

Love

😡

Angry

😭

Sad

😂

Funny

😱

Wow

Leave a Comment

Comments 0