বৃহস্পতিবার, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

সড়ক দুর্ঘটনায় পরিবারের ৭ স্বজনকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ প্রবাসী বাহার

বুধবার (৬ আগস্ট) ভোর সাড়ে ৫টার দিকে বাহার উদ্দিনকে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে আনার পথে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার চন্দ্রগঞ্জ পূর্ববাজারের জগদিশপুর এলাকায় মাইক্রোবাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খালে পড়ে তারা মারা যান। এতে বাহার উদ্দিন বাড়ি ফিরলেন ঠিকই, কিন্তু সঙ্গে নিলেন দুঃস্বপ্নের ভয়াবহ স্মৃতি।

ছবি: সংগৃহীত

জেলা প্রতিনিধি,

লক্ষ্মীপুর: প্রায় আড়াই বছর পর ওমান থেকে দেশে ফিরেছেন লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বাহার উদ্দিন। তার আনন্দঘন এই আগমন এখন বিষাদে পরিণত হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনায় পরিবারের সাত সদস্যকে হারিয়ে তিনি এখন বাকরুদ্ধ। এর আগে নিজের ফেসবুকে ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার’ স্ট্যাটাস দিয়ে দেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন তিনি।

বাহার উদ্দিন লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার উত্তর জয়পুর ইউনিয়নের চৌপল্লী গ্রামের কাশারি বাড়ির বাসিন্দা। সড়ক দুর্ঘটনায় মা, নানি, স্ত্রী, সন্তানসহ বাহারের সাত স্বজন মারা গেছেন।

বুধবার (৬ আগস্ট) ভোর সাড়ে ৫টার দিকে বাহার উদ্দিনকে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে আনার পথে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার চন্দ্রগঞ্জ পূর্ববাজারের জগদিশপুর এলাকায় মাইক্রোবাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খালে পড়ে তারা মারা যান। এতে বাহার উদ্দিন বাড়ি ফিরলেন ঠিকই, কিন্তু সঙ্গে নিলেন দুঃস্বপ্নের ভয়াবহ স্মৃতি।

দুর্ঘটনায় নিহতরা হলেন ওমান প্রবাসী বাহারের স্ত্রী কবিতা আক্তার (২৪), মেয়ে মীম আক্তার (২), মা মুরশিদা বেগম (৫০), নানি ফয়জুন নেছা (৭০), ভাতিজি রেশমা আক্তার (৯) ও লামিয়া আক্তার (৮) এবং বড় ভাইয়ের স্ত্রী লাবনী আক্তার (২৫)।

ভয়াবহ এ দুর্ঘটনায় বেঁচে যান বাহার উদ্দিন, তার বাবা আব্দুর রহিম, শ্বশুর ইস্কান্দার মির্জা, ভাবি সুইটি ও শ্যালক রিয়াজ।

বুধবার দুপুরে বাহার উদ্দিনের চৌপল্লি গ্রামের বাড়িতে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য দেখা যায়। একসঙ্গে সাতটি মরদেহ দেখে বাড়ির লোকজন, পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনরা শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন। বাড়ির অদুরে একসঙ্গে খোঁড়া হচ্ছে সাতটি কবর।

প্রতিবেশী মো. গোফরান সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‌‘বাহার উদ্দিন খুবই ভালো ছেলে। সবার সঙ্গে হাসিখুশি নিয়ে চলাচল করে। সে পরিবারের প্রতি খুবই যত্নশীল। তার আগমনকে উপলক্ষ করে পরিবারের সবাই ঢাকা গেলো। তার বাড়িতে আজ আনন্দের পরিবর্তে কঠিন শোকাচ্ছন্ন পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। এটা সত্যিই কষ্টের।’

বেঁচে ফেরা প্রবাসী বাহার উদ্দিন ও তার বাবা আব্দুর রহিম সংবাদমাধ্যমকে জানান, ঘুম চোখে মাইক্রোবাস চালাচ্ছিলেন রাসেল। বারবার বলা সত্ত্বেও গাড়ি থামিয়ে সামান্যও বিশ্রাম নেননি তিনি। এর আগে কুমিল্লায় দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে আসেন। কিন্তু বাড়ি থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার আগেই ঘুমন্ত চালক গাড়িটি সড়কের পাশে খালে ফেলে দেন। গাড়ি তাৎক্ষণিকভাবে ডোবেনি, ধীরে ধীরে ডুবছিল। তখন চালককে গাড়ির লক খুলতে বললেও খুলে দেননি। তবে তিনি নিজে গাড়ির কাচ নামিয়ে বের হয়ে পালিয়ে যান। কাউকে বাঁচানোর চেষ্টাও করেননি।

বাহার উদ্দিনের আত্মীয় মো. সুমন সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘আড়াই বছর পর বাহার উদ্দিন দেশে আসছেন। এই আনন্দে পরিবারের সবাই খুব আশা নিয়ে তাকে বরণ করে আনতে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যান। কিন্তু সেখান থেকে সাতজন ফিরেছেন নিথর দেহে। কীভাবে এ শোক সহ্য করবো জানি না। পুরো পরিবারটা শেষ হয়ে গেলো।’

বেগমগঞ্জের জগদিশপুর এলাকার বাসিন্দা শহিদুল ইসলাম। তিনি সংবাদমাধ্যমকে জানান, ভোর ৫টা ১৫ মিনিটের দিকে হঠাৎ দ্রুতগতিতে মাইক্রোবাসটি খালের পানিতে নেমে যায়। এর পরপরই চালক খালের পানি থেকে বের হয়ে পালিয়ে যান। বাহার উদ্দিনসহ পাঁচজন গ্লাস ভেঙে বের হয়ে আসতে পারলেও বাকি সাতজন গাড়ির ভেতরে আটকা পড়েন। তারা প্রায় দুই ঘণ্টা পানির নিচে ছিলেন।

শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা ফায়ার সার্ভিসের কাছে ডুবুরি চাইলে তারা জানান, এখানে ডুবুরি নেই। বেগমগঞ্জ ও মাইজদী থেকে দুটি ইউনিট এলেও তারা কাউকে উদ্ধার করতে পারেননি। পরে হাইওয়ে পুলিশের রেকার দিয়ে গাড়িটি ওঠানোর পর মরদেহগুলো উদ্ধার করা হয়।’

চন্দ্রগঞ্জ হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মোবারক হোসেন ভূঁইয়া সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘ধারণা করা হচ্ছে চালক ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তাই গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খালে পড়ে যায়।’

তিনি আরও জানান, চালকসহ গাড়িটিতে মোট ১৩ জন ছিলেন। চালক পালিয়ে গেলেও গাড়িটি জব্দ করা হয়েছে। মরদেহগুলো উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়। পরে স্বজনদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের নোয়াখালীর সহকারী পরিচালক মো. ফরিদ আহমেদ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, আমাদের মাইজদী ও চৌমুহনী স্টেশন থেকে দুটি ইউনিট উদ্ধার কাজে অংশ নেয়। তারা ডুবুরি চেয়েছিলেন কিন্তু আমাদের নিজস্ব ডুবুরি নেই। আমরা চাঁদপুর থেকে ডুবুরি দল চেয়ে আনি। তবে তার আগেই উদ্ধারকাজ শেষ হয়ে যায়।’

বেগমগঞ্জ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) লিটন দেওয়ান সংবাদমাধ্যমকে বলেন, সাতটি মরদেহসহ মাইক্রোবাসটি উদ্ধার করা হয়েছে। চন্দ্রগঞ্জ হাইওয়ে থানা থেকে দেওয়া অভিযোগ অনুযায়ী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

বাংলাফ্লো/এনআর

Leave a Comment

Comments 0