বাংলাফ্লো প্রতিনিধি,
ঢাকা: ইস্টার্ন রিফাইনারী ইউনিট-২ (ইআরএল) এর ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) দফায় দফায় কাটা-ছেঁড়ায় প্রায় সতেরো বছর পার হয়ে গেছে। প্রত্যেক দফায় খরচ বেড়েছে লাফিয়ে, একাদশ দফায় সংশোধনীতে ২৩ হাজার কোটি থেকে ৪২ হাজার কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকেছে।
বহুল আলোচিত ও কাঙ্ক্ষিত ইআরএল-২ প্রকল্পটি প্রথম আলোচনায় আসে ২০০৮ সালে। প্রথমে ১৩ হাজার কোটি টাকার বাজেট ধরা হলেও দশম দফায় সংশোধিত ডিপিপিতে ২৩ হাজার ৭৩৬ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়।
২০২৩ সালে প্রস্তাবিত ডিপিপিতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) তহবিল থেকে ৭ হাজার ১’শ কোটি টাকা এবং জিওবি তহবিল থেকে ১৬ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাব করা হয়। ওই ডিপিপিতে জুন ২০২৭ সালে প্রকল্প সমাপ্তের সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল।
ডিপিপি চূড়ান্ত হওয়ার আগেই সরকারের পতন হলে কিছুদিন থমকে ছিল ওই প্রকল্পটি। এরপর শুরু হয় একাদশ দফায় ডিপিপি সংশোধনের কাজ।
এবার প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয় বাড়িয়ে ৪২ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। সেই ডিপিপি ইতোমধ্যেই পরিকল্পনা কমিশনে প্রেরণ করা হয়।
পরিকল্পনা কমিশন কিছু বিষয়ে কোয়ারি (ব্যাখ্যা চেয়ে) দিয়ে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে প্রেরণ করেছে বলে জানিয়েছেন ইস্টার্ন রিফাইনারী লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরিফ হাসনাত। তিনি বলেছেন শিগগিরই আবার পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানোর কাজ চলছে বলে শুনেছি।
ব্যয় বাড়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, আগের ডিপিপি ছিল ২০১৭-১৮ সালের দর অনুযায়ী। তখন ডলারের দর এক রকম ছিল, এখন ডলারের দর অনেক বেড়ে গেছে। আবার বেশকিছু বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। যে কারণে প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে।
কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সিনিয়র সহ-সভাপতি জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, যারা অযৌক্তিকভাবে ব্যয় বাড়িয়ে দেয় তারা দেশ ও জাতির শত্রু। এভাবে অপচয় করে প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে জনগণের কাঁধে বোঝা চাপানো হচ্ছে।
বর্তমানে দেশে জ্বালানি তেলের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৬৮ লাখ মেট্রিক টন। বিপরীতে ইস্টার্ন রিফাইনারী মাত্র ১৫ লাখ ৪৫ হাজার ২৪৫ মেট্রিক টন পরিশোধিত জ্বালানির যোগান দেয়। বাকি প্রায় ৫২ লাখ মেট্রিক টন পরিশোধিত তেল আমদানি করতে হয় বিপিসিকে। দ্বিতীয় ইউনিটের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩০ লাখ মেট্রিক টন। পরিশোধিত তেল না এনে ক্রডওয়েল এনে পরিশোধন করা হলে লিটার প্রতি ডিজেলে কমপক্ষে ৫ থেকে ৬ টাকা করে সাশ্রয় হয় বলে বিপিসি সূত্র জানিয়েছে। বছরে বিশাল অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও কিছু ষড়যন্ত্রের কারণে প্রকল্প ঝুঁলেই রয়েছে।
দেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল) ১৯৬৮ সালে অপারেশন শুরু করে। ফরাসি প্রতিষ্ঠান টেকনিপের করা ওই ইউনিটের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল (৩০বছর) শেষ হলেও এখনও পুরোদমে চলছে। ২০২১ উৎপাদনের রেকর্ড গড়ে পুরস্কৃত হয়েছে। ১৫ লাখ টন উৎপাদন সক্ষমতার এই তেল শোধনাগারটি সক্ষমতা ছাড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। যে কারণে পুরনোটির আদলেই নতুন রিফাইনারী স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
২০২০ সালের দিকে ১১ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকার মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নে কিছু দেশ আগ্রহ দেখিয়েছিল। সেই কাজে ২৩ হাজার কোটি টাকার ডিপিপি প্রণয়ন নিয়ে তখন বিস্তর প্রশ্ন উঠেছিল। তখন ভ্রমণ বিলাস নিয়েও বিতর্ক ছিল। ওই দফায় ডিপিপিতে বিদেশ ভ্রমণ খাতেই বরাদ্দ প্রস্তাব ছিল ৮ কোটি ৬০ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। এসব ভ্রমণের বেশিরভাগই রাখা হয়েছে সমজাতীয় রিফাইনারী পরিদর্শন। প্রকল্পের আওতায় ১৮৪ জন কর্মকর্তার বিভিন্ন দেশ সফরের প্রস্তাব করা হয়। কয়েকটি ভ্রমণ রাখা হয়েছে স্ট্যাডি ট্যুর ও সমজাতীয় রিফাইনারী পরিদর্শনের। চট্টগ্রামের পতেঙ্গাতে ১৯৬৮ সাল থেকে সমজাতীয় কারখানা সফলতার সঙ্গে পরিচালিত হয়ে আসছে। বিদ্যমান কারখানার আলোকে পাশেই সম্প্রসারিত হচ্ছে ইআরএল ইউনিট-২। তারপরও কাড়ি কাড়ি ডলার খরচ করে বিদেশ ভ্রমণ যুক্ত রাখা হয়।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে ইআরএল ইউনিট-২ প্রসঙ্গে বিপিসি চেয়ারম্যান আমিন উল আহসান বলেছেন, বিপিসি ১ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার অর্থায়ন করবে। বাকি অর্থ সরকার অর্থায়ন করবে। প্রতিবছর বাজেট থেকে এখানে বরাদ্দ দেওয়া হবে। তহবিল নিশ্চিত হল ডিপিপিতে যাব। মহেশখালী ও পায়রায় রিফাইনারি নির্মাণের জন্য বিদেশি বিনিয়োগকারী খোঁজা হচ্ছে। মহেশখালীতে ১০ লাখ মেট্রিক টন উৎপাদন সক্ষমতার রিফাইনারি নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।
বাংলাফ্লো/এনআর
Comments 0