মঙ্গলবার, ২ সেপ্টেম্বর ২০২৫

'ঘুসের ওপরে ঘুস'— এনবিআরের দুর্নীতি নিয়ে ক্ষোভ

এনবিআরে এমন সব আইন করা হয়েছে যেটা মানা বাস্তবে সম্ভব নয়। ফলে আইনের হাত থেকে বাঁচতে "বাধ্য হয়েই ঘুস দিতে হয়"।

ছবিঃ সংগৃহীত

বাংলাফ্লো ডেস্ক

ঢাকা: এনবিআরে (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) দুর্নীতি ছাড়া কাজ হয় না এমন অভিযোগ বহু ব্যবসায়ীর।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন বা বিকেএমইএ'র নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামিম এহসান বলেন, ঘুষ ছাড়া এনবিআরে কাজ করাই দায়।

বলতে পারেন ঘুসের ওপরে ঘুস দিতে হয়। মানে যে ঘুসটা আমাদের দিতে হয়, সেটা তো আমরা অনেক সময় কোম্পানির খরচের হিসাবে কাগজে-কলমে দেখাতে পারি না। ফলে আদার এক্সপেন্স (অন্যান্য খরচ) নামে যে খরচের খাতে এই ঘুসের খরচটা লিখতে হয়, সেটা অ্যাপ্রুভ করতে আবারও ঘুস দিতে হয়। মানে ঘুস ওপরে ঘুস।

তার মতে, এনবিআরে এমন সব আইন করা হয়েছে যেটা মানা বাস্তবে সম্ভব নয়। ফলে আইনের হাত থেকে বাঁচতে বাধ্য হয়েই ঘুস দিতে হয়।

উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, দেখেন এখানে সিস্টেম হচ্ছে, যখন আপনি রপ্তানি করবেন তখন আপনি ভ্যাট অফিসে খবর দেবেন। সে আপনাকে একটা ডকুমেন্টস দেবে। প্রতিটা ট্রাকের সঙ্গে সেই ডুকমেন্টসটা চট্টগ্রাম বন্দরে যাবে। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ থেকে তখন সেটাকে অ্যাপ্রুভ করে এনে আবার ভ্যাট অফিসে জমা দেবে।

মি. এহসান বলেন, এটা তো সম্ভব নয়। আমার যদি রাত ১২টায় শিপমেন্ট হয়, তখন কি ভ্যাট অফিসারকে আমি পাবো? শুধু নারায়ণগঞ্জেই যতো গার্মেন্টস আছে, এখানে তিনশত গার্মেন্টসের যদি একদিনে রপ্তানি আইটেম থাকে, সেটা অ্যাপ্রুভ করার মতো পর্যাপ্ত অফিসার আছে নারায়ণগঞ্জ?

তো এসব আইন বাস্তবায়নযোগ্য না। কিন্তু যখন আমি এটা মানবো না, তখন যদি আমাকে এসে বলা হয় আপনি আইন মানেন নাই, তখন আমি ঘুস না দিয়ে কোথায় যাবো?

এনবিআরে দুর্নীতির এমন যত অভিযোগ সেগুলো নতুন নয়। সেবাখাতে দুর্নীতি নিয়ে ২০২৪ সালে প্রকাশিত টিআইবির সর্বশেষ রিপোর্টেও এনবিআরের অনিয়ম-দুর্নীতির কথা উঠে আসে।

যেখানে বলা হয় এনবিআরে সেবা নিতে যাওয়া খানার মধ্যে ১৭ দশমিক ৯ শতাংশ খানা অনিয়ম-দুর্নীতির শিকার হয়েছে।

জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বিবিসি বাংলাকে বলেন, এনবিআর এমন অবস্থায় পৌঁছে গেছে যে এটা দুর্নীতিবাজদের জন্য একটা স্বর্গ।

তিনি বলেন, যেসব তথ্য-উপাত্ত এর আগে প্রকাশিত হয়েছে, বিভিন্ন মামলার প্রেক্ষিতে দুদক এর আগে যেসব কথা বলেছে, তাতে এটা প্রতিষ্ঠিত যে এনবিআরে যারা কর ফাঁকি দিতে চায়, অবৈধ লেনদেন করতে চায়, অর্থপাচার করতে চায়, তাদের জন্য এনবিআর স্বর্গ। কিন্তু যারা আইন মেনে কর দিতে চান তাদেরকে একরকম জিম্মি করে অর্থ আদায় করা হয়। এটা যে শতভাগ হচ্ছে তেমনটা বলবো না। তবে সার্বিক চিত্র এমনই।

তার মতে, রাজস্ব আদায় সুষ্ঠুভাবে না হওয়ায় রাজস্ব ঘাটতি হচ্ছে, রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

এখানে এর আগে ছাগলকাণ্ডে অভিযুক্ত ব্যক্তির দুর্নীতির কথা আমরা গণমাধ্যমে দেখেছি। এরকম যারা আছে, তাদের কয়েকজনের ফাইল ট্র্যাক করে তারা কাদের কর ফাঁকি এবং তার মাধ্যমে অর্থ পাচারের সুযোগ করে দিয়েছেন, সেটা যদি বের করা হয় তাহলে পরিষ্কারভাবেই দেখা যাবে যে বাংলাদেশে কেন কর আদায় কম হয়, কেন আমরা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছি, কেন এখানে কর-জিডিপি দক্ষিণ এশিয়ার সর্বনিম্ন, বলেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।

দেখা যাচ্ছে, শুধু ঘুস-দুর্নীতির অভিযোগ নয়, এনবিআর তার মূল কাজ অর্থাৎ রাজস্ব আহরণেও দুর্বল।

বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত আটের নিচে। দেশটি গত ৫০ বছরে কখনই রাজস্ব আদায়ের প্রাথমিক লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি, বরং রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে প্রতিবছর।

এছাড়া সুবিধামতো আইন প্রণয়ন এবং আইনের ফাঁদে ফেলে ঘুস লেনদেনের অভিযোগও আছে।

সব মিলিয়ে এনবিআরে বড় ধরনের সংস্কার ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না বলেই মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের গবেষণা পরিচালক ড. মাহফুজ কবীর বিবিসি বাংলাকে বলেন, যে আন্দোলন হয়েছে সেটা জাতীয় স্বার্থে না হয়ে বরং ব্যক্তিগত স্বার্থে হয়েছে।

সবার কাছেই একটা প্রশ্ন যে এনবিআরে অস্বচ্ছতা আছে। তারা নিজেরাই নীতি ঠিক করছেন, নিজেরাই বাস্তবায়ন করছেন। ফলে এখানে আলাদা প্রতিষ্ঠান দরকার ছিল।

এখন আন্দোলনকারীদের মূল কথা হলো যেই অধ্যাদেশ জারি হয়েছে, সেটার সংশোধন লাগবে। কিন্তু যে কারণে আন্দোলন হচ্ছে, সেটা ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত। এখানে জাতীয় স্বার্থে যে আন্দোলন হয়েছে ব্যাপারটা সেরকম নয়। ক্যাডারের বাইরে থেকে এখানে লোক নিয়োগ হতেই পারে। এটা অস্বাভাবিক নয়, বলেন মাহফুজ কবীর।

আন্দোলকারীরা গত রোববারই আন্দোলন প্রত্যাহার করেছেন। এরপর গত কয়েকদিনে সরকার বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে।

দুর্নীতি দমন কমিশনও বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু করেছে।

সূত্র: বিবিসি

বাংলাফ্লো/আফি

Post Reaction

👍

Like

👎

Dislike

😍

Love

😡

Angry

😭

Sad

😂

Funny

😱

Wow

Leave a Comment

Comments 0