বাংলাফ্লো প্রতিনিধি
ঢাকা: রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় বিএনপি নেতা কামরুল আহসান সাধনকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যার ঘটনায় ১৮ দিন পেরিয়ে গেলেও এখনও খুনিদের গ্রেফতার করতে পারেননি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এ হত্যাকাণ্ডে কারা অংশগ্রহণ করেছে, হত্যার নেপথ্যে কারা, কিংবা কেন সাধনকে হত্যা করা হয়েছে? সেসব বিষয়ে এখনও ধোঁয়াশায় রয়েছেন তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা। তবে এ হত্যাকাণ্ডের মোটিভ খুঁজতে থানা পুলিশের পাশাপাশি ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) কাজ করছে।
তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধনকে যারা হত্যা করেছে, তারা এলাকার কেউ নয়। ভাড়াটে কিলার দিয়ে এ হত্যাকাণ্ড ঘটনানো হয়েছে। যদিও সাধনকে দুজন অস্ত্রধারী সরাসরি গুলি করে হত্যা নিশ্চিত করে। তবে সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ঘটনাস্থলের আশেপাশে থাকা কিলিং মিশনে আরও কয়েকজনের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে পুলিশ।
তদন্ত সূত্রে আরও জানা যায়, সাধন হত্যাকাণ্ডের পেছনে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও ব্যবসা, আধিপত্য এবং আন্ডাওয়ার্ল্ডের গডফাদারের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। বিশেষ করে গুলশান ও বাড্ডা এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে তোলা চাঁদার টাকা জমা থাকতো নিহত বিএনপি নেতা সাধনের কাছে। পরে সেই টাকা বিভিন্ন শীর্ষ সন্ত্রাসীর কাছে যেতো। ফলে আন্ডারওয়ার্ল্ডের সঙ্গে চাঁদার টাকা নিয়ে ভাগভাটোয়ার দ্বন্দ্বের কারণে সাধন খুন হতে পারেন বলে ধারণা করছেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা।
নিহত বিএনপি নেতা কামরুল আহসান সাধন গুলশান থানা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। গত মাসের ২৫ মে রাত ১০টার দিকে মধ্য বাড্ডার গুদারাঘাটের একটি দায়ের দোকানে ৪-৫ জন বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন তিনি। এসময় আগ্নেয়াস্ত্র হাতে মাস্ক পরা দুই যুবক এসে সাধনকে লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ে এবং তার মৃত্যু নিশ্চিত করে তারা দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। সন্ত্রাসীদের গুলিতে সাধনের ঘাড়, কাঁধ, পিঠ, বুক এবং পেটে গুলি লাগে। পরে বন্ধুরা তাকে উদ্ধার করে সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরবর্তী সময়ে এ ঘটনায় তার স্ত্রী দিলরুবা বাদী হয়ে বাড্ডা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। নিহত সাধন নিঃসন্তান ছিলেন। স্ত্রীকে নিয়ে মধ্য বাড্ডা এলাকায় ভাড়া থাকতেন। তিনি গুলশান থানা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। ইন্টারনেট ব্যবসার পাশাপাশি ঠিকাদারি ব্যবসাও করতেন।
বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইফুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘তদন্তে এখনও পর্যন্ত তেমন অগ্রগতি নেই। সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দুই আসামিকে শনাক্ত করা হয়েছে। তবে তারা ওই এলাকার না। ধারণা করা হচ্ছে, তারা (খুনিরা) ভাড়াটে কিলার।’ র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার এম জেড এম ইন্তেখাব চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বিএনপি নেতা সাধন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আমরা ছায়া তদন্ত করছি। বলার মতো এখনও তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। তবে আশা করছি, আসামিদের দ্রুত গ্রেফতার করতে সক্ষম হবো। আমাদের গোয়েন্দা দলের সদস্যরা কাজ করছেন।
বিএনপি নেতা সাধন হত্যার প্রত্যক্ষদর্শী ও তার বন্ধু মো. কামরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা প্রায়ই গুদারাঘাটের ওই চায়ের দোকানের সামনে বসে আড্ডা দিতাম। সেদিন রাতে আমরা সেখানে বসার পর পর দুজন অস্ত্রধারী এসে সরাসরি সাধনকে লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি করে। আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই খুনিরা দ্রুত পালিয়ে যায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘নিহত সাধন ও আমি একই বাসায় থাকি। তার সঙ্গে কারও কোনও কোন্দল আছে কিনা, বা কেউ হুমকি দিয়েছিল কিনা, তা আমার জানা নেই। তবে তিনি যেহেতু রাজনীতি করতেন। তাই অনেকের সঙ্গে তার ওঠাবসা ছিল।’
তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় ব্যবসা, আধিপত্য, চাঁদাবাজি ও টাকার ভাগভাটোয়ারা নিয়ে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সঙ্গে নানা দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে। এসব দ্বন্দ্বের কারণে বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ঘটেছে। বিশেষ করে গত ২১ মার্চ গুলশান পুলিশ প্লাজার সামনের সড়কে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় সুমন মিয়া ওরফে টেলি সুমন (৩৩) নামে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবসায়ীকে। সুমন মিয়া ছিলেন বাড্ডা এলাকার সন্ত্রাসী মেহেদী গ্রুপের অনুসারী। তাকে গুলি করে হত্যা করে রবিন, ডালিম ও মাহবুব গ্রুপের লোকেরা। আর এই মাহবুবের মামা ছিলেন সাধন।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা যায়, সাধন হত্যার পেছনে মেহেদী গ্রুপ ও রবিন গ্রুপসহ আরও কয়েকটি শীর্ষ সন্ত্রাসী গ্রুপের নাম উঠে এসেছে। এসব যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত ঘটনা উৎঘাটনে কাজ করছেন পুলিশ ও গোয়েন্দারা। জানা যায়, গুলশান ও বাড্ডা এলাকায় ইন্টারনেট ব্যবসা, ডিশ সংযোগ, মাদককারবার, আবাসন ব্যবসা, দখল, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন ধরনের বৈধ-অবৈধ ব্যবসা নিয়ে অন্তত তিনটি সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে। চাঁদাবাজির ভাগ-ভাটোয়ারা, আধিপত্য বিস্তার ও ব্যবসা- বাণিজ্যের দখল নিতে তিনটি গ্রুপই মরিয়া হয়ে উঠেছে। দেশি- বিদেশি অস্ত্রের মহড়া, প্রতিপক্ষকে হুমকি, মারামারিসহ বিভিন্ন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা হরহামেশা হচ্ছে। এরমধ্যে রবিন-ডালিম-মাহবুব গ্রুপ, মেহেদী গ্রুপ ও জিসান গ্রুপ রয়েছে। প্রতিটি গ্রুপে অর্ধশতাধিক অস্ত্রধারী সদস্য রয়েছে। পুলিশের খাতায় তারা সবাই আন্ডাওয়ার্ল্ডের অপরাধী।
সূত্র বলছে, শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান দুবাই বসে তার গ্যাং ও ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে। আর মেহেদী গ্রুপের মহেদী যুক্তরাষ্ট্র থেকে আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করছে। অপরদিকে রবিন-ডালিম-মাহবুব গ্রুপের এই তিন সন্ত্রাসী বর্তমানে মালয়েশিয়ায় রয়েছে। তিনটি গ্রুপই রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছে। যখন যারা ক্ষমতায় আসে, তাদের সঙ্গে সখ্যতা রেখে তারা অপকর্ম করে। রাজনৈতিক নেতারাও তাদের কাছ থেকে সুবিধা নেন। সাধন হত্যায় আন্ডারওয়ার্ল্ডের এই তিনটি গ্রুপের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে ধারণা তদন্ত কর্মকর্তাদের।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) মো. মহিতুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘খুনিরা ভাড়াটে কিলার। এখনও তাদের গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। তবে তাদের দ্রুত গ্রেফতারে আমাদের একাধিক টিম কাজ করছে।’ তিরি আরও বলেন, ‘এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে অনেকগুলো ঘটনা পাওয়া গেছে। আমরা সম্ভাব্য সবগুলো কারণ নিয়ে কাজ করছি। আশা করছি, এ হত্যার মোটিভ দ্রুত উদঘাটন করা যাবে।’
বাংলাফ্লো/এসও
Like
Dislike
Love
Angry
Sad
Funny
Wow
Comments 0