বাংলাফ্লো প্রতিনিধি
ঢাকা: দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ১৯৬৭ সালে রমনা উদ্যানে যে বর্ষবরণ অনুষ্ঠিত হয় সেটিই এখন বাঙালির বর্ষবরণের অন্যতম বড় উৎসব।
দেশে তখন চলছিল আইয়ুব খানের কঠিন সামরিক শাসন। পূর্ব পাকিস্তানে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জারি করা হয়েছিল নিষেধাজ্ঞা। ছায়ানট সেই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বাঙালি সংস্কৃতির জাগরণে বিপুল উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে আয়োজন করেছিল পয়লা বৈশাখে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান।
১৯৬৭ সালে যাদের হাত ধরে নগরে বর্ষবরণের গোড়াপত্তন হয়েছিল, তাদের মাঝে সেদিন সামনের সারিতেই ছিলেন সন্জীদা খাতুন। এবারই প্রথম তাকে ছাড়া নববর্ষকে বরণ করতে হলো ছায়ানটকে।
গত ২৫ মার্চ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পরে ছায়ানটের এটাই প্রথম নববর্ষ পালন। আনন্দের মাঝে তাই গুরুজন হারানোর বিষাদ তো ছিলই প্রস্তুতিতে।
এবারের বর্ষবরণের আয়োজনে সন্জীদা খাতুনকে স্মরণ করে বিশেষ কিছু আয়োজন না থাকলেও আয়োজকরা জানান, বর্ষবরণের বাণী সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারাটাই হবে সন্জীদা খাতুনের প্রতি শ্রদ্ধা। আয়োজনটি সুষ্ঠুভাবে করে, বর্ষবরণের মর্মবাণী সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারাটাই হবে সন্জীদা খাতুনকে শ্রদ্ধা জানানো।
ছায়ানটের বর্ষবরণ কথনে প্রায় প্রতিবছরই থাকত সন্জীদা খাতুনের বক্তব্য। এবার ছায়ানটের হয়ে বর্ষবরণ কথনে অংশ নেন নির্বাহী সভাপতি ডা. সারওয়ার আলী।
এ সময় তিনি বলেন, সংস্কৃতির নির্বিঘ্ন যাত্রা ধারণ করলে মুক্তির পথ সুগম হবে। আমরা এক আলোকিত দেশ ও সমাজের স্বপ্ন দেখি, যে দেশের মানুষ সর্বজনের শান্তি-স্বস্তি -নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ধর্ম জাতি বিত্তের বিভাজন ভাঙবে, গড়বে উদার সম্প্রীতির সহিঞ্চু সমাজ।
তিনি আরও বলেন, সবাই ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণ, মুক্তচিন্তার নির্ভয় প্রকাশ, আবহমান সংস্কৃতির নির্বিঘ্ন যাত্রা হৃদয়ে ধারণ করলে মুক্তির আলোকোজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সুগম হবেই।
সারওয়ার আলী বলেন, নববর্ষের ঊষালগ্নে, আজ চোখ ফেলি হিসাব-নিকাশের হালখাতায়। একদিকে মুক্তির জন-আকাঙ্ক্ষা অর্জনের প্রত্যাশা, অন্যদিকে পীড়াদায়ক বিদ্বেষ-বিভক্তি, নারী-শিশুর অমানবিক মর্যাদাহানি ও অপরিণামদর্শী অসহিষ্ণুতা। সব অতৃপ্তি প্রতিবিধানের দায় রাষ্ট্রের, তবে সমাজকেও সেই দায় নিতে হবে।
যা ছিল এবারের আয়োজনে
ভোরের আলো ফুটতে ফুটতে, সুপ্রিয়া দাসের ভৈরবীর রাগালাপে ছায়ানটের ১৪৩২ বর্ষবরণের আয়োজন শুরু করে ছায়ানট।
সোমবার (১৪ এপ্রিল) রাজধানীর রমনা উদ্যানের বটমূলে ছায়ানটের ৫৮তম এ আয়োজন যথারীতি শুরু হয় নতুন বছরের প্রথম দিন ভোর সোয়া ৬টায়। বাঙালি সমাজকে নিয়ে মুক্তির পথযাত্রী হতে এবার ছায়ানটের বর্ষবরণের বার্তা- ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’।
ছায়ানটের প্রভাতি এই আয়োজনে রাগালাপের পর সম্মেলক কণ্ঠে ‘নতুন প্রাণ দাও ‘রবীন্দ্র সংগীত গায় শিল্পীরা। এরপর ২ টি রবীন্দ্র সঙ্গীত যেখানে দীপ্র নিশান্ত পরিবেশন করেন ‘তিমির দুয়ার খোলো’ এবং সেঁজুতি বড়ুয়ার পরিবেশন করেন, 'আপনারে দিয়ে রচিলি রে কি এ’ গানটি।
এরপর কাজী নজরুল ইসলামের সম্মেলক গান তুমি প্রভাতের সকরুণ ভৈরবী পরিবেশিত হয় সবার কণ্ঠে। একক গান ভেঙেছো দুয়ার এসেছ জ্যোতির্ময় গানটি গান মোস্তাফিজুর রহমাস তুর্য।
গানের পর পালাক্রমে এ প্রভাতি আয়োজনে শোনানো হয় কবিতা। রবীন্দ্রনাথের ঝড়ের খেয়া’র নির্বাচিত অংশ পাঠ করেন, জহিরুল হক খান।
এরপর আবার রবীন্দ্রনাথের সম্মেলক গান ‘জয় হোক তব জয়’। একক গান রবীন্দ্রসংগীত তোর ভিতরে জাগিয়া কে যে গানটি গায় ফারজানা আক্তার পপি। রবীন্দ্রের পর নজরুল সংগীত জগতের নাথ করো পার হে’ গানটি গায় সুমন মজুমদার।
এরপর আবার রবীন্দ্র সংগীত পরিবেশিত হয়, সবার কণ্ঠে সম্মেলক মোরা সত্যের’পরে মন।
ফারহানা আক্তার শ্যার্লি গায় দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ আজি নতুন রতনে গানটি। কাজী নজরুলের, গগনে প্রলয় মেঘের মেলা গানটি গায় খায়রুল আনাম শাকিল।
এরপর আবার কবিতা। পাঠ করেন সুমনা বিশ্বাস। কাজী নজরুলের দাও শৌর্য, দাও ধৈর্য কবিতা।
সম্মেলক গান এরপর, রবীন্দ্র সংগীত,আমার মুক্তি আলোয় আলোয় পরিবেশিত হয় সবার কণ্ঠে।
রবীন্দ্র লাইসা আহমদ লিসা গান, আকাশে দুই হাতে প্রেম বিলায়। নজরুল সংগীত মোরা এক বৃন্তে দু’টি কুসুম গানটি সবাই মিলে পরিবেশন করা হয়। নজরুল সংগীত ভাইয়ের দোরে ভাই কেঁদে যায় গানটি গায় সৈয়দা সনজিদা জোহরা বীথিকা। সুস্মিতা দেবনাথ শুচি গায় নজরুলের মৃত্যু না, নাই দুঃখ গানটি।
এরপর সম্মেলক গান আব্দুল লতিফের, এই বাংলা রবি ঠাকুরের গানটি গায় সবাই। একক গান পরিবেশন করেন, আবুল কালাম আজাদ। তিনি রশীদ উদ্দিনের লেখা ও সুর করা, এ বিশ্ব মাঝে যেখানে যা সাজে গানটি গান। লালন শাহর, মন সহজে কি সই হবা…. গানটি গান চন্দনা মজুমদার।
এরপর কবিতা আবৃতি করেন জয়ন্ত রায়। তিনি পাঠ করেন, অনিকেত রাজেশ’র সভ্যতা কবিতাটি।
ও আলোর পথযাত্রী, সলিল চৌধুরীর লেখা ও সির করা সম্মেলক গানটি গান সবাই। পর পর দু’টি সম্মেলক গান হয়। দ্বিতীয় সম্মেলক গানটি ছিল আইজ আইলো রে বছর ঘুরি।
এরপর ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি, সারওয়ার আলী কখন ও জাতীয় সংগীত দিয়ে শেষ হয় ১৪৩২ এর বর্ষবরণ অনুষ্ঠান।
এবারের আয়োজনের মাঝে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি গণহত্যার তীব্র নিন্দা জানিয়ে অনুষ্ঠানে এক মিনিট নীরবতাও পালন করে ছায়ানট।
বাংলাফ্লো/এসবি
Comments 0