Logo

চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা, সাড়ে চার হাজার কোটি ব্যয় বাড়িয়েও হচ্ছেনা প্রতিকার

সহরজুড়ে খাল রয়েছে ৫৭টি। কিন্তু জলাবদ্ধতার গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোতে সংস্কারের জন্য খাল রাখা হয়েছে মাত্র ৩৬টি

ছবি: সংগৃহীত

জেলা প্রতিনিধি 

চট্টগ্রাম: সহরজুড়ে খাল রয়েছে ৫৭টি। কিন্তু জলাবদ্ধতার গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোতে সংস্কারের জন্য খাল রাখা হয়েছে মাত্র ৩৬টি। ২১টি খালকে সংস্কারের বাইরে রেখেই তড়িঘড়ি করে তিন সংস্থা নিয়েছে চার প্রকল্প। এসব প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খরচও করে ফেলেছে তারা ৮ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। তবুও বর্ষা এলে দফায় দফায় ডুবছে বন্দর নগরী। খাল-নালায় পড়ে মরছে মানুষ। প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। যথাযথভাবে সমীক্ষা না করে নেওয়া এসব প্রকল্পের খেসারতও গুনতে হচ্ছে ৬০ লাখ নগরবাসীকে। প্রকল্পের মাঝপথে এসে পরিবর্তন করতে হচ্ছে নকশা। বাড়াতে হচ্ছে ব্যয়ও। চারটি প্রকল্পের মধ্যে তিনটিতেই মাঝপথে ব্যয় বেড়েছে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। আরেকটি প্রকল্পে ব্যয় না বাড়লেও সেটির কমাতে হয়েছে কর্মপরিধি। 

২০২১ সালের জুনে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প তদারককারী প্রতিষ্ঠান বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) সিডিএর প্রকল্পটি নিয়ে মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করেছিল। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, এত বড় প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদনটিও সঠিকভাবে করা হয়নি। যেটি করা হয়েছে, সেটিও অনেক ত্রুটিপূর্ণ। আবার প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যাপারে অর্থবছরভিত্তিক আর্থিক ও বাস্তব কর্মপরিকল্পনাও ছিল না সিডিএর। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। এখন ব্যয় ও সময় দুটিই বাড়ছে।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, জলাবদ্ধতার মূল কাজ বাস্তবায়ন করছে সিডিএ। প্রকল্পগুলো গ্রহণ করার আগে যথাযথভাবে সমীক্ষা করা হয়নি। নগরীতে ৫৭টি খাল থাকলেও তারা প্রকল্প নিয়েছে ৩৬টি খাল নিয়ে। আবার খালপাড়ে যেসব অবৈধ ভবন আছে, সেগুলোর ব্যাপারেও যথাযথভাবে জরিপ করা হয়নি। এসবের কারণে মাঝপথে প্রকল্পের নকশা পরিবর্তন করতে হচ্ছে, বাড়ছে ব্যয়ও। 

মিলছে না কাঙ্ক্ষিত সুফল

২০১৭ সালে নেওয়া হয় ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনর্খনন, সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন প্রকল্প’। কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০২০ সালের জুনে। এখন পর্যন্ত কাজ হয়েছে ৭৫ শতাংশ। ৫ হাজার ৬১৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটির এখন ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা। ব্যয় বেড়েছে ৩ হাজার ১০ কোটি টাকা। একই বছর নেওয়া কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০২০ সালের জুনে। এখন পর্যন্ত কাজ হয়েছে ৮২ শতাংশ। ২ হাজার ৩১০ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটি এখন হয়েছে ২ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকা। ব্যয় বেড়েছে ৪৬৯ কোটি টাকা। 

গত বছর নেওয়া বারইপাড়া খাল খনন প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০১৭ সালের জুনে। এখন পর্যন্ত কাজ শেষ হয়েছে ৮০ শতাংশ। ২৮৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকার প্রকল্পটি এখন ১৩৬২ কোটি টাকা। ব্যয় বেড়েছে ১০৭৩ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে চট্টগ্রাম মহানগরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ জলমগ্নতা বা জলাবদ্ধতা নিরসন, নিষ্কাশন ও উন্নয়ন প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০২০ সালের জুনে। এখন পর্যন্ত কাজ হয়েছে মাত্র ৪৩ শতাংশ। ব্যয় হয়েছে ৪৩১ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ৮৩০০ কোটি টাকা খরচ হলেও কাঙ্ক্ষিত সুফল পাচ্ছে না নগরবাসী। গত বছর বর্ষায় অন্তত সাত দফা জলাবদ্ধতায় ডুবেছে চট্টগ্রাম নগরী।  

ব্যয় বাড়ায় বরাদ্দ পেতে ভোগান্তি

তিন প্রকল্পেই ব্যয় বেড়েছে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। মাঝপথে এভাবে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বরাদ্দ পেতে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে প্রকল্প-সংশ্লিষ্টদের। জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফেরদৌস আহমেদ প্রকল্পটির সর্বশেষ অগ্রগতি প্রতিবেদনে বলেন, শুরু থেকে চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ না পাওয়ায় প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ ও ভৌত কাজ নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী অগ্রসর হয়নি। 

এ ছাড়া প্রকল্পটির প্রথম ডিপিপিতে ৪৫১৫ বর্গমিটার স্থাপনার ক্ষতিপূরণ ধরা হয় মাত্র ১৭ কোটি টাকা। মাঠ পর্যায়ে সমীক্ষার পর সেটি দাঁড়ায় ৬৮ হাজার ৯৩ বর্গমিটারে। ক্ষতিপূরণ দাঁড়ায় ২২৪ কোটি টাকা। স্থাপনার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৬৩ হাজার ৫৭৮ বর্গমিটার। ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২০৭ কোটি টাকা। বরাদ্দ না পাওয়ায় প্রায় ১৮০৪টি স্থাপনা উচ্ছেদ ঝুলে আছে। প্রকল্পটির শুরুতে ৬ হাজার ৫১৬ কাঠা জায়গা অধিগ্রহণের পরিকল্পনা ছিল সিডিএর। কিন্তু তিন গুণ ক্ষতিপূরণ হওয়ায় ৪২৩৬ কাঠা জমি অধিগ্রহণের পরিমাণ কমানো হয়। এখন ২২৮০ কাঠা ভূমি অধিগ্রহণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮৯১ কোটি টাকা। সাত বছরে বরাদ্দ পাওয়া গেছে মাত্র ১৭১ কোটি টাকা। বরাদ্দের অভাবে ২১টি খালের পাশে সড়কসহ সংস্কারকাজ আটকে আছে। সর্বশেষ অগ্রগতি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পের শুরু থেকে চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ না পাওয়ায় ভূমি অধিগ্রহণ ও ভৌত কাজ নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী অগ্রসর হয়নি। 

এ ছাড়া ‘কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ’ প্রকল্পটি ২৪৩ কোটি টাকা বরাদ্দ না মেলায় ভূমি অধিগ্রহণ আটকে আছে। গত দুই অর্থবছরে ভূমি অধিগ্রহণে কোনো বরাদ্দ পায়নি প্রকল্পটি। 

কখনোই তদন্ত কমিটি গঠন করেনি দুই সংস্থা

চট্টগ্রামে গত ১০ বছরে খাল-নালায় পড়ে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এসব মৃত্যু হয়েছে সিটি করপোরেশনের খাল ও নালা এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রকল্প এলাকায়। এসব মৃত্যুর একটিতেও তদন্ত কমিটি করেনি সরকারি দুই সংস্থা। কারও বিরুদ্ধে নেওয়া হয়নি কোনো আইনি ব্যবস্থাও। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও হাইকোর্টের নির্দেশে দুটি তদন্ত কমিটি হলেও সেখানে কেউ দায় স্বীকার করেনি। কিন্তু প্রতিবেদনে সংস্থা দুটিকে দায়ী করেই দায় সেরেছে সরকার। গত শুক্রবার রাতে খালে পড়ে নিহত শিশু সেহেরিজের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এতে দায়ীদের শনাক্ত কিংবা কারা দায়ী, তা নির্ধারণে দুটি সংস্থার কেউই কমিটি গঠন করেনি।

এ প্রসঙ্গে চসিকের সিইও শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, শিশুটি খালে পড়ার পর থেকে মেয়র থেকে শুরু করে সবাই উদ্ধার কার্যক্রম ও তদারকিতে ছিলেন। এখানে তদন্ত করে নতুন করে বের করার কিছু নেই। তাছাড়া এখানে আমাদের কোনো দায় নেই। কারণ আমরা নিরাপত্তা বেষ্টনী দিয়েছিলাম। সিডিএ জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ করতে গিয়ে বেষ্টনী সরিয়েছে।

সিডিএর চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নুরুল করিম বলেন, খালটিতে আমরা এখনও কাজ শুরু করিনি। তাই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি। বর্ষার আগে শুধু ময়লা পরিষ্কার করা হয়েছে। এর পর নিরাপত্তার জন্য একটি বাঁশ দেওয়া হয়েছিল। সেটি কে বা কারা নিয়ে গেছে। তবুও নগরের যেসব জায়গা অরক্ষিত আছে, সেগুলো নিরাপদ করতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাফ্লো/এসকে

Related Posts বাংলাদেশ

Leave a Comment

Comments 0