জেলা প্রতিনিধি
চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির (বার অ্যাসোসিয়েশন) ২০২৪-২৫ মেয়াদের নির্বাচনে কোনো ধরনের ভোট ছাড়াই বিএনপি ও জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীরা ২১টি পদে জয়ী হতে যাচ্ছেন।
চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির ১৩২ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এই প্রথমবার একক প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে সবাই বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়ে যাচ্ছেন— এখন যার ঘোষণা দেওয়া কেবল বাকি।
আইনজীবী সমিতির ভোটারের সংখ্যা যেখানে ৫ হাজার ৪০৪ জন, সেখানে কোনো প্রকার ভোট গ্রহণ না হওয়া এবং প্রতিটি পদে কেবল একক প্রার্থী দিয়ে পদ ভাগাভাগি করে নেওয়াকে সমিতির প্রবীণ সদস্যরা ‘গণতন্ত্রহীনতার উদ্বেগজনক লক্ষণ’ হিসেবে দেখছেন।
শুক্রবার (১১ এপ্রিল) মনোনয়ন যাচাই-বাছাই শেষে প্রত্যেক পদের একক প্রার্থীর মনোনয়ন বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে।
তবে নির্বাচন ঘিরে শুরু থেকেই অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
আওয়ামী লীগ ও এলডিপি সমর্থিত আইনজীবীরা দাবি করছেন, তাদের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করতে দেওয়া হয়নি, বরং পরিকল্পিতভাবে বাধা দেওয়া হয়েছে।
এবার জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ ২১টি পদের মধ্যে ১৪টি পদে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের আনুষ্ঠানিকভাবে বিজয়ী ঘোষণা করা হবে।
তাঁরা হলেন সভাপতি আবদুস সাত্তার, সাধারণ সম্পাদক হাসান আলী চৌধুরী, জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি কাজী মো. সিরু, অর্থ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন, পাঠাগার সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম, সাংস্কৃতিক সম্পাদক আশরাফী বিনতে মোতালেব, ক্রীড়া সম্পাদক মঞ্জুর হোসেন এবং সদস্য আহসান উল্লাহ, আসমা খানম, বিবি ফাতেমা, মেজবাহ উল আলম, রায়হানুল ওয়াজেদ চৌধুরী, রাহিলা গুলশান ও সাজ্জাদ কামরুল হোসেন।
আর বাকি সাতটি পদে জামায়াত–সমর্থিত প্রার্থীরা রয়েছেন। তাঁরা হলেন সহসভাপতি আলমগীর মোহাম্মদ ইউনুস, সহসম্পাদক ফজলুল বারী, তথ্য ও প্রযুক্তি সম্পাদক আবদুল জব্বার এবং সদস্য শাহেদ হোসেন, হেলাল উদ্দিন, রোবায়তুল করিম ও মোহাম্মদ মোরশেদ।
তফসিল ঘোষণার পর থেকে মনোনয়ন সংগ্রহে গিয়ে বাধার মুখে পড়েছেন আওয়ামী লীগ ও এলডিপি সমর্থিত আইনজীবীরা।
সভাপতি পদে নির্বাচন করতে আগ্রহী আওয়ামীপন্থি অ্যাডভোকেট আবদুর রশিদ জানিয়েছেন, সমিতির ৯৮ শতাংশ সদস্য ভোট দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কয়েকজন পরিকল্পিতভাবে এই নির্বাচনকে ভোটবিহীন ও একচেটিয়া করে ফেলেছে।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে মনোনয়নপত্র নিতে আওয়ামীপন্থী আইনজীবীদের বাধা দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। আওয়ামীপন্থী আইনজীবী সভাপতি প্রার্থী আবদুর রশিদ, সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী ফখরুদ্দিন চৌধুরীসহ চারজন প্রার্থীর সই করা লিখিত অভিযোগে বলা হয়, দুপুরে সমিতির পাঠাগার থেকে মনোনয়ন ফরম কেনার জন্য যান তাঁরা। ওই সময় তাঁদের বাধা দেওয়া হয়। সেখানে আইনজীবীর পাশাপাশি কিছু বহিরাগতও ছিলেন। পরে নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কয়েকজন সদস্যকে বলা হলেও তাঁরা কেউ মনোনয়ন ফরম কিনতে যাওয়া আইনজীবীদের সঙ্গে যাননি।
জানতে চাইলে মুখ্য নির্বাচন কর্মকর্তা তারিক আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, প্রত্যেক পদের জন্য একজন করে মনোনয়ন দিয়েছেন। যাচাই-বাছাইয়ে সেগুলো বৈধ পাওয়া গেছে। তাই নিয়ম অনুযায়ী বিজয়ী ঘোষণা করা হবে। আমরা কাল নির্বাচন কমিটির সবাই বসে সিদ্ধান্ত নেব। দিন ঠিক করে সাংবাদিক ডেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে ফলাফল ঘোষণা করা হবে।
অভিযোগে বিষয়ে তিনি বলেন, আমাকের কেউ লিখিত বা ফোন করে ফরন নিতে না পারার কোন অভিযোগ জানায়নি।
এর আগে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল ১০ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে ৪ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন পরিচালনায় নিয়োজিত কমিটির পাঁচজন কর্মকর্তা একযোগে পদত্যাগ করেন। পরে ১৬ ফেব্রুয়ারি গঠিত হয় অ্যাডহক কমিটি। প্রাথমিকভাবে ১৬ এপ্রিল ভোটের দিন নির্ধারিত থাকলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন মনোনয়ন জমা পড়ায় সেটি আর হচ্ছে না।
সোনালি ইতিহাসে কালো দাগ
চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির ইতিহাসে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বড় ধরনের কোনো বিরোধ দেখা যায়নি। গত ১৬ বছরে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের আইনজীবীরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন এবং গণতান্ত্রিকভাবে ভোট দিয়ে বিজয়ী হয়েছেন। তবে এবার, নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বিকৃতি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ সমিতির ঐতিহ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বলে মনে করছেন সমিতির বেশিরভাগ সদস্যই।
অনেক আইনজীবী মনে করছেন, এই ঘটনায় আইনজীবী সমিতির ইতিহাসে বড় ধরনের দাগ পড়েছে। সমিতির মধ্যে দলীয় রাজনীতির এমন প্রকাশ্য ও জোরপূর্বক প্রকাশ আগে কখনও দেখা যায়নি।
চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির প্রবীণ সদস্যরা বলছেন, ‘এই নির্বাচনী পরিবেশে যারা পদে বসতে যাচ্ছেন, তাদের নৈতিক ভিত্তি ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে। বার নির্বাচন শুধু পদের বিষয় নয়; এটি একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা। আর যখন সেই সংস্কৃতি বাধা, বিভাজন ও একচেটিয়া পরিকল্পনায় রূপ নেয়, তখন সেটা গোটা বিচারব্যবস্থার জন্যই উদ্বেগজনক বার্তা বহন করে।’
তবে আইনজীবীদের অনেকে অভিযোগ করেছেন, গত বছরের জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরা ‘স্বৈরাচারের দোসর’ হিসেবে সরাসরি কাজ করেছেন। তাদের অভিযোগ, গত বছরের ৩১ জুলাই চট্টগ্রাম আদালতে কর্মসূচি পালনকালে ‘শেখ হাসিনার দোসর আওয়ামীপন্থী আইনজীবীরা’ আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালান। পরে ৪ আগস্ট নগরীর নিউ মার্কেট এলাকায় পুলিশ, আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের সন্ত্রাসীরা ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হামলা চালালে আন্দোলনে অংশ নেওয়া নিরীহ ছাত্ররা আদালত ভবনে আশ্রয় নিলে তাদের ওপর হামলা হয় আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীদের নেতৃত্বে।
বাংলাফ্লো/এসবি
Comments 0