বাংলাফ্লো প্রতিনিধি
ঢাকা: আওয়ামী লীগের টানা চার মেয়াদের শাসনামলে দেশের চামড়া শিল্পে ধস নামে। সম্ভাবনাময় ও লাভজনক এই শিল্পটি নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে বলে গুঞ্জন ছিলো।
চামড়া শিল্পে ধস কাটিয়ে ওঠতে এবারের ঈদুল আজহায় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কোরবানির পশুর চামড়ার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। চামড়ার দাম নিয়ে কারসাজি রুখতে কিছু উদ্যোগের কথাও জানানো হয়েছিল সরকারের পক্ষ থেকে।
এতে অনেকেই আশাবাদী হয়ে উঠছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়েছেন এই খাত সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে মৌসুমি ব্যবসায়ী যারা কোরবানির চামড়া সংগ্রহের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তারা চরম হতাশ। যারা চামড়া বিক্রি করছেন তারাও আশানুরূপ দাম না পেয়ে খুশি নন।
এবার সরকার ঢাকায় সর্বনিম্ন কাঁচা চামড়ার দাম এক হাজার ৩৫০ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। আর ঢাকার বাইরে সর্বনিম্ন দাম নির্ধারণ করা হয় এক হাজার ১৫০ টাকা। এছাড়া খাসির লবণযুক্ত চামড়া ২২ থেকে ২৭ টাকা ও বকরির চামড়া ২০-২২ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
তবে বাস্তবে এর তেমন কোনো প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়নি। বিশেষ করে গরুর কাঁচা চামড়া আগের মতোই কম দামে বিক্রি হয়েছে। আর অন্যান্য বছরের মতো এবারও ছাগলের চামড়া কিনতে আগ্রহ দেখাননি অধিকাংশ আড়তদার।
রাজধানীতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গরুর কাঁচা চামড়া মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ৭০০ থেকে ৯০০ টাকার মধ্যে। ছোট চামড়া ৬০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। গত বছরও দাম ছিল প্রায় একই রকম। আর ছাগলের চামড়া বিক্রি হয়েছে মাত্র পাঁচ থেকে ১০ টাকায়।
গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও চামড়া ছিল অনেকটা ফেলনা বস্তুর মতো। বেশির ভাগ কোরবানিদাতা মৌসুমি ক্রেতাদের সাড়া না পেয়ে পুরো চামড়া কোনো মাদরাসায় বা লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে দান করে দিয়েছেন। বিভিন্ন মাদরাসা ও লিল্লাহ বোর্ডিং যে চামড়া সংগ্রহ করেছে সেগুলোও সরকার নির্ধারিত দামের প্রায় অর্ধেক দামে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে।
রাজধানীর রামপুরায় মৌসুমি ব্যবসায়ী হাসমত আলী জানান, তারা ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা দরে চামড়া সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু কোনো আড়তদার বা ট্যানারি প্রতিষ্ঠান ৭৫০ টাকার ওপরে দাম দিতে চায় না। তাই বাধ্য হয়ে ৭৫০ টাকা দরেই তারা চামড়া বিক্রি করেছেন। এতে তাদের লাভ তো দূরের কথা অনেক লোকসান গুনতে হয়েছে।
রাজধানীর আরেক চামড়া ব্যবসায়ী রাকিব জানান, সারা দিনে তারা এক হাজারের বেশি চামড়া সংগ্রহ করেছেন। সর্বোচ্চ ৭০০ টাকা পর্যন্ত দাম উঠেছে। অথচ তারা এর চেয়ে বেশি দামে কিনেছেন। তিনি জানান, গতবার তারা সংগৃহীত চামড়া ৯০০–১০০০ টাকা দরে বিক্রি করতে পেরেছিলেন। ধারণা ছিল, এবার অনেক বেশি দামে বিক্রি করতে পারবেন। কিন্তু এবার তাদের বড় গচ্চা দিতে হচ্ছে।
আড়তদাররা বলছেন, একটি চামড়ার প্রক্রিয়াজাতকরণ, পরিবহন ও আড়তের খরচ মিলে প্রায় ৫০০ টাকা পড়ে। সেই সঙ্গে ট্যানারি মালিকেরা ২০ শতাংশ বাদ দেন, ফলে অধিক দামে চামড়া কেনা সম্ভব হয় না।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাবেক সভাপতি মো. মুসলিম উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, লবণ ছাড়া চামড়া বেশি দামে কেনার সুযোগ নেই। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা এ বিষয়টি মাথায় রাখেন না। এ কারণে অনেক সময় তারা লোকসান দেন।
চামড়ার দামে খুশি নন কোরবানিদাতারাও। রাজধানীর গেন্ডারিয়ার বাহাউদ্দিন জানান, তাদের আড়াই লাখ টাকার গরুর চামড়ার দাম ৬০০ টাকা বলেছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। পরে তারা পাশের মাদরাসায় পুরো চামড়াটি দান করে দেন।
মালিবাগের একটি মাদরাসার পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, দিনভর ছাত্র-শিক্ষকের পরিশ্রমে তিনশ চামড়া তারা সংগ্রহ করেছিলেন। পোস্তায় বিক্রি করতে নিয়ে গেলে সর্বোচ্চ দাম উঠেছে ৭০০ টাকা পর্যন্ত। পরে বাধ্য হয়ে সেই দামেই বিক্রি করে দিতে হয়েছে। তিনি জানান, এত কম দাম হবে জানলে তারা এবার চামড়া কালেকশন করতেন না।
পোস্তার চামড়া ব্যবসায়ী সুমন অ্যান্ড সন্সের স্বত্বাধিকারী মো. শরীফ জানান, প্রতিটি গরুর চামড়া ৭০০ থেকে ৯০০ টাকায় তারা কিনছেন। তার ভাষ্য, একেকটি চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে লবণ ও শ্রমিকের মজুরি বাবদ খরচ পড়ে যাবে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা। বাজার মন্দা, সে জন্য গতবারের চেয়ে কিছুটা কমে কিনছেন।
বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক টিপু সুলতান বলেন, গত বছর আমাদের এক কোটি পিস চামড়া সংগ্রহ হয়েছিল। এবার সেটি ১০ থেকে ২০ শতাংশ কমে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। কারণ গরুর আমদানি কম হয়েছে, বাজারে আগ্রহও কম। সেই সঙ্গে দেখা যাচ্ছে, লবণের কৃত্রিম সংকট আবারও তৈরি করা হয়েছে।
বাংলাফ্লো/এনআর
Comments 0