বাংলাফ্লো প্রতিনিধি,
ঢাকা: দেশের ব্যাংকিং খাত ইতিহাসের সবচেয়ে সংকটজনক সময় পার করছে। প্রথমবারের মতো খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুন মাসে শেষে দেশের ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের প্রায় ২৭ শতাংশ।
এই ঋণের পরিমাণ গত মার্চের চেয়ে এক লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা বেশি। আর ২০২৪ সালের জুনের তুলনায় খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ লাখ ১৯ হাজার কোটি টাকা, যা শতকরা হিসাবে ১৫১ শতাংশেরও বেশি প্রবৃদ্ধি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, খেলাপি ঋণ লুকিয়ে রাখার সুযোগ কমে যাওয়ার ফলে ব্যাংকগুলো এখন পুরো চিত্র তুলে ধরছে। আগে যেসব ঋণ নানা নীতিসহায়তায় ‘নিয়মিত’ দেখানো হতো, সেগুলো এখন শ্রেণিকরণে পড়ে খেলাপি হিসেবে গণ্য হচ্ছে। ফলে হঠাৎ করেই খেলাপি ঋণের পরিমাণে এ বিপুল বৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে।
ঋণ শ্রেণিকরণ নীতির পরিবর্তন বড় কারণ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ শ্রেণিকরণে কঠোর নীতি গ্রহণ করায় বাস্তব চিত্র সামনে আসছে। এর আগে ছয় মাস পর্যন্ত ঋণ পরিশোধ না করলেও খেলাপি হিসেবে ধরা হতো না। এখন ঋণের মেয়াদ শেষ হলেই তা মেয়াদোত্তীর্ণ ধরা হচ্ছে।
“আগে যেসব ঋণ গোপন রাখা হতো, এখন তা প্রকাশ করা হচ্ছে। এতে খেলাপির পরিমাণ বাড়ছে। পাশাপাশি ব্যাংকের মূলধনে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে, তারল্য সংকট বাড়ছে এবং অনেক ব্যাংক লোকসানে যাচ্ছে।”
এস আলম গ্রুপের ঋণ ও ইসলামী ধারার ব্যাংকের সংকট
বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর নজরদারিতে সাম্প্রতিক সময়ে আলোচনার কেন্দ্রে থাকা এস আলম গ্রুপ-নিয়ন্ত্রিত পাঁচটি ইসলামী ধারার ব্যাংকের দুর্বল অবস্থা সামনে এসেছে। এই পাঁচ ব্যাংকের গড় খেলাপি ঋণের হার প্রায় ৭০ শতাংশ।
এই ব্যাংকগুলো হলো— ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল), ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল)।
বাংলাদেশ ব্যাংক এ পাঁচটি ব্যাংককে একীভূত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে, যাতে সামগ্রিক ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। পাশাপাশি, এক্সিম ব্যাংক, অগ্রণী ও জনতা ব্যাংকসহ অনেক ব্যাংকেই খেলাপি ঋণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে।
পুরনো নীতির ফাঁকফোকরেই খেলাপির বিস্তার
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের সময় ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। সেই সময় ব্যাংক খাত আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছিল। তবে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ঋণ পুনঃতফশিল ও পুনর্গঠনের সুযোগ চালু হয়, যার ফলে বহু বড় ঋণ খেলাপি না দেখিয়ে নিয়মিত দেখানো হয়েছে।
এরপর করোনাকালীন সময়ে এবং ২০২১-২৩ সাল পর্যন্ত সামান্য কিস্তি দিয়েই বড় ঋণ নিয়মিত দেখানোর সুযোগ দেওয়া হয়। প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতাদের জন্য বিশেষ বিবেচনায় নীতিনির্ধারণী ছাড় দেওয়া হয়েছে বারবার, যার কুফল এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
প্রভাব পড়ছে তারল্য ও মুনাফায়
বিপুল অঙ্কের খেলাপি ঋণের কারণে অনেক ব্যাংক তারল্য সংকটে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর নির্দেশনায় এবার ৩৬টি তালিকাভুক্ত ব্যাংকের মধ্যে ২০টি ব্যাংক লভ্যাংশ দিতে পারেনি। কোনও ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের বেশি হলে আগামী বছর তারা মুনাফা করলেও লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারবে না।
ড. আহসান এইচ মনসুর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, তিনি খেলাপি ঋণ ও অনিয়মের বিরুদ্ধে আগেই কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। তার নেতৃত্বে ব্যাংক খাতের বাস্তব চিত্র উঠে আসছে। তিনি বলেন, “প্রকৃত চিত্র ছাড়া সুষ্ঠু নীতিনির্ধারণ সম্ভব নয়। ব্যাংক খাতকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতেই খেলাপি ঋণের গোপন সুযোগ বন্ধ করা হয়েছে।”
খেলাপি ঋণ নবায়নের চেষ্টা
বর্তমানে প্রায় ১ হাজার ২০০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তাদের খেলাপি ঋণ নবায়নের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিসহায়তা চেয়ে আবেদন করেছে। ইতোমধ্যে শতাধিক প্রতিষ্ঠান এই সুবিধা পেয়েছে।
উল্লেখ্য, দেশের ব্যাংক খাত বর্তমানে এক গভীর সংকট মোকাবিলা করছে। দীর্ঘদিনের নীতিশৈথিল্য, রাজনৈতিক প্রভাব, অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা মিলিয়ে খেলাপি ঋণ আজ এক ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছে। সামনে আরও চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন। তবে বাস্তব চিত্র সামনে আসা ইতিবাচক দিক— যা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের জন্য একটি শক্তিশালী আর্থিক কাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব।
বাংলাফ্লো/এনআর
Comments 0