স্পোর্টস ডেস্ক
ঢাকা: রাত পোহালেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ছাপিয়ে সাধারণ নাগরিক জীবনের আলোচনায় ডাকসুর ভিপি-জিএস প্রার্থীরা। আশি-নব্বইয়ের দশকে ভিপি-জিএসের সাথে তুমুল আলোচনায় থাকত ক্রীড়া সম্পাদক পদও। কালের বিবর্তনে ক্রীড়া সম্পাদক পদে এখন আর সেই আকর্ষণ ও আলোচনা নেই।
ডাকসুর সাবেক ক্রীড়া সম্পাদক সাবেক জাতীয় ফুটবলার ও কোচ শফিকুল ইসলাম মানিক। ডাকসু নির্বাচনের স্মৃতি হাতড়ে বলেন, ‘আশির দশকে ডাকসু নির্বাচনে ভিপি-জিএসের মতোই আলোচনায় থাকত ক্রীড়া সম্পাদক। আকর্ষণের বিবেচনায় বরং কোনো ক্ষেত্রে বেশিই।’ আকর্ষণ বেশি হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করলেন ডাকসু নির্বাচনে ক্রীড়া সম্পাদকে বিজিত প্রার্থী কায়সার হামিদ, ‘ভিপি-জিএসদের পরিচিতি থাকত মূলত ক্যাম্পাস কেন্দ্রিক। আর যারা ক্রীড়া সম্পাদক প্রার্থী হত তারা জাতীয় তারকা। যখন নির্বাচন করি তখন বোধ হয় আমি জাতীয় দলেরও অধিনায়ক ছিলাম। মানিক ভাইও সুপরিচিত ফুটবলার। অন্য সব প্রার্থীদের মধ্যে কেবল ক্রীড়া সম্পাদকের আলাদা জাতীয় পরিচিতি ছিল।’
ডাকসুর আরেক ক্রীড়া সম্পাদক জাতীয় দলের সাবেক গোলরক্ষক ছাইদ হাসান কানন। তিনি ক্রীড়া সম্পাদক প্রার্থীদের আলোচনা ও জনপ্রিয়তা নিয়ে বলেন, ‘আমাদের নির্বাচনের সময় ক্যাম্পাসে ভিপি-জিএসের চেয়ে পোস্টার-ব্যানার ক্রীড়া সম্পাদকের প্রায় সমান ছিল। কখনো আবার বেশিও লেগেছে।’
ডাকসুর আলোচিত ও জনপ্রিয় ক্রীড়া সম্পাদক ছিলেন বাদল রায়। ডাকসুর ক্রীড়া সম্পাদকদের মধ্যে তিনিই সবার আগে পৃথিবী ছেড়েছেন। তার জীবদ্দশায় ডাকসুর সোনালী দিনের গল্প করতেন প্রায়ই। এতে উঠে আসত সেই সময় ফুটবলারদের জনপ্রিয়তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার পরিবেশসহ নানা দিক।
ক্রীড়া সম্পাদক পদে নির্বাচন বাড়তি আগ্রহ হওয়ার কারণও রয়েছে। একই পদে প্রার্থী হতেন একাধিক তারকা ক্রীড়াবিদ। ১৯৮৯ সালে শফিকুল ইসলাম মানিক যখন প্রার্থী। তখন তার প্রতিদ্বন্দ্বী কায়সার হামিদ। সেই সময় কায়সারের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বি। পরের বছর নির্বাচনে আবারও দুই জন প্রার্থী হন। তখন তাদের সাথে যোগ দেন আরো দুই তারকা ফুটবলার ইমতিয়াজ সুলতান জনি ও ছাইদ হাসান কানন। কায়সার হামিদ পরবর্তীতে নির্বাচন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেও জনি, কানন ও মানিকের মধ্যে নির্বাচন হয়। তিন জনই তখন মোহামেডানের ফুটবলার এবং একই রুমে থাকতেন। ওয়াহিদুজ্জামান পিন্টু ও বাদল রায়কেও ক্রীড়াবিদদের হারিয়েই জয়ী হয়েছিলেন।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ডাকসু নির্বাচনে ক্রীড়া সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন গোলরক্ষক ওয়াহিদুজ্জামান পিন্টু। তিনি একবার জাসদ আরেকবার বাসদ থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৮১ সালে ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে জিতেছিলেন তারকা ফুটবলার বাদল রায়। এরপর আট বছর ডাকসু নির্বাচন হয়নি। ১৯৮৯ সালে ছাত্রদলের প্রার্থী কায়সারকে পরাজিত করেছিলেন সম্মিলিত প্রার্থী মানিক। পরের বছর ছাত্রদল মনোনীত প্রার্থী কানন আবার মানিককে পরাজিত করেন।
ডাকসু নির্বাচনে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্যানেল হলেও ক্রীড়া সম্পাদক পদটি এর উর্ধ্বেই ছিল বলে মত দুই ক্রীড়া সম্পাদক কানন ও মানিকের। তারা বলেন, ‘ক্রীড়া সম্পাদক প্রার্থীরা ছিলেন সবার। তাদেরকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা কোনো দলের মনে করতেন না। ক্রীড়া সম্পাদকরাও দলের গন্ডিতে আবদ্ধ ছিল না।’
ডাকসুর সাংগঠনিক কাঠামোতে সভাপতি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মূলত অন্যতম নীতি-নির্ধারক। তবে ডাকসুর সভাগুলোতে ক্রীড়া সম্পাদকদের মূল্যায়নও ছিল অনেক, ‘আমি যখন ক্রীড়া সম্পাদক তখন ভিপি-জিএস দুই জনই খেলার জন্য আলাদা ফান্ড দিয়েছিলেন। শারীরিক শিক্ষা বিভাগ মাঠ কোনো সংস্থাকে বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রেও ক্রীড়া সম্পাদকের মতামত গুরুত্ব সহকারে নিত’-বলেন শফিকুল ইসলাম মানিক।
ডাকসুর সকল ক্রীড়া সম্পাদকই ফুটবলার। তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীও ছিলেন ফুটবলার। সেই সময় প্রার্থী না হলেও ক্রিকেটার গাজী আশরাফ হোসেন লিপু বেশ উপভোগ্যই করতেন ডাকসু নির্বাচন, ‘আমরা ক্যাম্পাসে পিন্টু ভাই ও বাদল ভাইকে ক্রীড়া সম্পাদক হিসেবে পেয়েছি। আন্তঃবিভাগ ও হলের খেলাগুলো বেশ জমজমাট হতো। ফলে ক্রীড়া সম্পাদক প্রার্থী নিয়ে সবার মধ্যেই একটা আকর্ষণ থাকত। ক্রীড়া সম্পাদক ছাড়াও ভিপি-জিএসদের বক্তৃতাও আগ্রহ নিয়ে শুনেছি। নেতৃত্বের গুণাগুণের পাশাপাশি তখন তাদের জ্ঞানের গভীরতাতেও মুগ্ধ হতাম। খুব সুন্দর, উৎসবমুখর পরিবেশে সুষ্ঠ নির্বাচন হতো।’
দুই যুগ পর ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল। সেখানে ক্রীড়া সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন তানভীর আহমেদ। যিনি ক্রীড়াবিদ ছিলেন না এমনকি ক্রীড়াঙ্গনেও সেভাবে সম্পৃক্ততাও ছিল না। ছয় বছর পর আবার ডাকসু নির্বাচন হচ্ছে। এবার এই পদে একাধিক প্রার্থী রয়েছেন। এদের মধ্যে একজন ক্রিকেটার, কারাতেকা রয়েছেন। তবে তাদের জাতীয় পর্যায়ের পরিচিতি সেই অর্থে নেই।
মাঝে অনেক দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলোয়াড় কোটা ছিল না। বছর তিনেক যাবত জাতীয় পর্যায়ের খেলোয়াড়রা সরাসরি ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। এরপরও তারকা খেলোয়াড়রা প্রার্থী না হওয়ায় খানিকটা হতাশ কানন, ‘ফুটবল, ক্রিকেট, হকি জাতীয় দলের অনেকেই এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। তাদের মধ্যে থেকে একজন প্রার্থী হলে ক্রীড়া সম্পাদক পদে আকর্ষণ ও জৌলুস আর বাড়ত।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন ক্রিকেটার তৌহিদ হৃদয়, ফুটবলার ঋতুপর্ণা চাকমা, শেখ মোরসালিনসহ আরো অনেক তারকা ক্রীড়াবিদ পড়াশোনা করছেন। তাদের নির্বাচনে আগ্রহী না হওয়ার কারণ সম্পর্কে লিপুর অভিমত,‘নির্বাচনের বিষয়টি তাদের ব্যক্তিগতই। এরপরও আমার মনে হয় এখন ফুটবল, ক্রিকেটে অত্যন্ত ব্যস্ত সূচি। সেই বিবেচনায় হয়তো তারা এতে আগ্রহী হননি।’
বাংলাফ্লো/এসও
Like
Dislike
Love
Angry
Sad
Funny
Wow
Comments 0