বাংলাফ্লো প্রতিনিধি
ঢাকা: ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর, নিউইয়র্ক সিটির সকালটা ছিল অন্য দিনের মতোই উজ্জ্বল ও শান্ত। আকাশে ছিল নির্মল নীল, অফিসগামী মানুষ ব্যস্ত ছিল কফি হাতে সাবওয়ে ধরতে কিংবা ট্যাক্সি থামাতে। কিন্তু সকাল ৮টা ৪৬ মিনিটে আকাশ চিরে আসা এক বিমানের আঘাতেই ভেঙে যায় সেই স্বাভাবিকতা। মাত্র ১৭ মিনিটের ব্যবধানে আরেকটি বিমান ধাক্কা দেয় পাশের টাওয়ারে। আমেরিকার অর্থনৈতিক শক্তির প্রতীক টুইন টাওয়ার দুটো মুহূর্তেই পরিণত হয় আগুনে জ্বলতে থাকা ধ্বংসস্তূপে।
সেদিন মোট চারটি যাত্রীবাহী বিমান ছিনতাই হয়েছিল। দুটি আঘাত হানে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে, একটি ভেঙে পড়ে ওয়াশিংটন ডিসির পেন্টাগনে, আর চতুর্থ বিমানটি পেনসিলভানিয়ার একটি মাঠে বিধ্বস্ত হয় সাহসী যাত্রীদের প্রতিরোধের মুখে। ওই ভয়ঙ্কর হামলায় প্রাণ হারান প্রায় ৩ হাজার মানুষ, আহত হন প্রায় ২৫ হাজার। টুইন টাওয়ারে যখন উড়োজাহাজ হামলা চালানো হয়, তখন ভবনটিতে ১৭ হাজার ৪০০ মানুষ ছিলেন। নর্থ টাওয়ারে যেখানে হামলা হয়, সে স্থানের কেউই বাঁচতে পারেননি; কিন্তু ১৮ জন সাউথ টাওয়ারের ইমপ্যাক্ট জোনের ওপরের মেঝে থেকে বেঁচে যান।
হতাহত মানুষের মধ্যে ৭৭ দেশের নাগরিক ছিলেন। এই হামলায় নিউইয়র্ক নগরের ৪৪১ উদ্ধারকর্মী নিহত হন। হামলার পর হাজারো মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে বিষাক্ত ধ্বংসস্তূপে কাজ করা অনেক অগ্নিনির্বাপণকর্মীও ছিলেন।
এমন ভয়াবহ ঘটনার দায় স্বীকার করে আল-কায়েদা, যার নেতৃত্বে ছিলেন ওসামা বিন লাদেন। মূল পরিকল্পক হিসেবে চিহ্নিত হন খালিদ শেখ মোহাম্মদ। হামলার পরপরই যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান শুরু করে, পরে ইরাকেও যুদ্ধ ছড়িয়ে যায়। সেই যুদ্ধ আজও বৈশ্বিক রাজনীতির গতিপথকে প্রভাবিত করছে।
তবে ৯/১১ শুধু সন্ত্রাসের গল্প নয়। ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকেও মানবতার আলো ছড়িয়ে পড়েছিল। দমকলকর্মী, পুলিশ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ—অনেকে নিজের জীবন বাজি রেখে অচেনা মানুষকে বাঁচাতে ছুটে গিয়েছিলেন। এই মানবিক গল্পগুলো আজও মনে করিয়ে দেয়, ঘৃণা যত ভয়াবহই হোক, তার বিপরীতে ভালোবাসা ও সহমর্মিতাই মানুষের আসল শক্তি।
২৪ বছর পেরিয়েও ক্ষত পুরোপুরি শুকোয়নি। আজও ১,১০০-এর বেশি ভিকটিমের পরিচয় অজানা। বিজ্ঞানীরা আধুনিক ডিএনএ প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রতিটি ভিকটিমকে শনাক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আগস্ট ২০২৫ পর্যন্ত নতুন করে আরও ৩ জনের পরিচয় নিশ্চিত করা হয়েছে।
প্রতি বছর এই দিনটিতে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে আয়োজন করা হয় স্মরণ অনুষ্ঠান। নিউইয়র্কে ৯/১১ মেমোরিয়াল ও মিউজিয়ামে নিহতদের নাম পাঠ করা হয়, পালিত হয় নীরবতা। স্থানীয় সময় সকাল ৮টা ৪৬ মিনিটে বাজানো হয় 'বেল অব হোপ'—যে মুহূর্তে প্রথম বিমানটি আঘাত করেছিল। পেন্টাগন ও পেনসিলভানিয়াতেও অনুষ্ঠিত হয় স্মরণসভা।
১১ই সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলায় নিহতদের মধ্যে ৬ জন বাংলাদেশি ছিলেন। নিহতের তালিকায় রয়েছেন মুক্তাগাছার নূরুল হক মিয়া এবং তার স্ত্রী মৌলভীবাজারের শাকিলা ইয়াসমীন, সুনামগঞ্জের সাব্বির আহমেদ, কুমিল্লার মো. শাহজাহান, সিলেটের সালাহউদ্দিন চৌধুরী এবং নোয়াখালীর আবুল কে. চৌধুরী। যাদের স্মরণে নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশি কমিউনিটির পক্ষ থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়।
সেদিনের আগুন আজও ইতিহাসের পাতায় ধূসর ধোঁয়া হয়ে ভাসে। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের জায়গায় আজ দাঁড়িয়ে আছে ৯/১১ মেমোরিয়াল, জাদুঘর আর নতুন করে গড়া ওয়ান ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার—যার উচ্চতা ১,৭৭৬ ফুট। কিন্তু স্মৃতির দেয়াল ছুঁয়ে গেলে এখনও ভেসে ওঠে সেই বিভীষিকাময় সকাল, যে সকাল মানব ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দিয়েছিল।
৯/১১ আমাদের শেখায়—সন্ত্রাস ধ্বংস ডেকে আনে, কিন্তু মানবিকতা সৃষ্টি করে আশার আলো। আর সেই ক্ষত, হয়তো কোনোদিনই শুকাবে না।
বাংলাফ্লো/সিএস
Like
Dislike
Love
Angry
Sad
Funny
Wow
Comments 0