Logo

ইসরায়েল-ইরান সংঘাতের পরিণতি কি হতে পারে?

সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু যুক্তরাষ্ট্রের কাছেই এমন বোমারু বিমান ও বাংকার ধ্বংসকারী বোমা রয়েছে, যা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা, বিশেষ করে ভূগর্ভের গভীরে থাকা স্থাপনাগুলোতেও আঘাত হানতে সক্ষম।

ফাইল ছবি

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

ঢাকা: ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সংঘাত এখন আর কেবল দেশ দুটির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে দুই পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানানো হলেও সেটা আমলে নেই নি এই দুই দেশ।  

লড়াই আরো তীব্র ও ব্যাপক হলে এই পরিস্থিতির সবচেয়ে খারাপ কী হতে পারে তার, সম্ভাব্য পরিণতিগুলো তুলে ধরা হলো :

জড়িয়ে পড়তে পারে যুক্তরাষ্ট্র

যুক্তরাষ্ট্র যতই অস্বীকার করুক, ইরান স্পষ্টতই বিশ্বাস করে—মার্কিন বাহিনী ইসরায়েলের আক্রমণকে সমর্থন করেছিল। অন্তত নীরবে হলেও সমর্থন ছিল তাদের।

তার জেরে ইরান মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে মার্কিন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে, যেমন ইরাকে বিশেষ বাহিনীর ক্যাম্প, উপসাগরের সামরিক ঘাঁটি ও এই অঞ্চলের কূটনৈতিক মিশনসমূহে।

এ ছাড়া ইরানের প্রক্সি বাহিনী—হামাস ও হিজবুল্লাহ দুর্বল হয়ে থাকতে পারে; কিন্তু ইরাকে ইরান সমর্থক মিলিশিয়ারা সশস্ত্র ও অক্ষত অবস্থায়ই রয়েছে।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রও যে এমন হামলার শঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছে না, তাদের কিছু কর্মীকে প্রত্যাহার করে নেওয়া তারই প্রমাণ। একই সঙ্গে কোনো মার্কিন লক্ষ্যবস্তুতে হামলার পরিণতি সম্পর্কে ইরানকে সতর্ক করে বার্তা দিয়েছে দেশটি।

তবে কোনো মার্কিন নাগরিক যদি তেল আবিব বা অন্য কোথাও নিহত হন, তাহলে কী হতে পারে? তাহলে ডোনাল্ড ট্রাম্প হয়তো পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হতে পারেন।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের অভিযোগ, তিনি ইরানকে পরাজিত করতে সাহায্যের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে টেনে আনতে চান। সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু যুক্তরাষ্ট্রের কাছেই এমন বোমারু বিমান ও বাংকার ধ্বংসকারী বোমা রয়েছে, যা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা, বিশেষ করে ভূগর্ভের গভীরে থাকা স্থাপনাগুলোতেও আঘাত হানতে সক্ষম।

ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে বলেছিলেন, তিনি মধ্যপ্রাচ্যে কোনো তথাকথিত ‘অনন্তকালের যুদ্ধ’ শুরু করবেন না।

কিন্তু এসবের সমান্তরালে অনেক রিপাবলিকান ইসরায়েলি সরকার ও তাদের এই দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করেন যে এখন তেহরানে শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের সময় এসেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হয়ে উঠলে দীর্ঘ, যা ধ্বংসাত্মক পরিণতি বয়ে আনবে।

উপসাগরীয় দেশগুলোও জড়িয়ে পড়তে পারে

ইরান যদি ইসরায়েলের সুরক্ষিত সামরিক বা অন্য স্থাপনার ক্ষতি করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তারা উপসাগরীয় অঞ্চলের অন্যান্য দুর্বল লক্ষ্যবস্তুকে নিশানা করতে পারে। বিশেষ করে, ইরানের মতে যেসব দেশ বছরের পর বছর ধরে তার শত্রুদের সহায়তা ও মদদ দিয়েছে। ওই অঞ্চলে প্রচুর জ্বালানি ও অবকাঠামোগত লক্ষ্যবস্তু রয়েছে।

মনে রাখতে হবে, ২০১৯ সালে সৌদি আরবের তেলক্ষেত্রে হামলা চালানোর অভিযোগ আনা হয়েছিল ইরানের বিরুদ্ধে এবং তাদের প্রক্সি হুতি গোষ্ঠী ২০২২ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে আঘাত হানে। তার পর থেকে অবশ্য ইরান ও এই অঞ্চলের কয়েকটি দেশের মধ্যে মিটমাটের প্রচেষ্টাও দেখা যায়। কিন্তু এই দেশগুলোতে মার্কিন বিমান ঘাঁটি রয়েছে। কিছু দেশ গত বছর ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা থেকে ইসরায়েলকে রক্ষায় গোপনে সহায়তা করেছিল।

যদি উপসাগরীয় অঞ্চলে হামলা হয়, তাহলেও ইসরায়েলের পাশাপাশি মার্কিন যুদ্ধবিমানগুলোকে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর প্রতিরক্ষায় এগিয়ে আসার মতো তাগিদ সামনে নিয়ে আসতে পারে।

ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা ধ্বংস করতে ইসরায়েল ব্যর্থ হলে

যদি ইসরায়েলি আক্রমণ ব্যর্থ হয়? যদি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা মাটির খুব গভীরে থাকে ও খুব সুরক্ষিত থাকে? সম্পূর্ণরূপে অস্ত্রে পরিণত হওয়ার থেকে মাত্র এক ধাপ দূরে থাকা ৪০০ কেজি পারমাণবিক জ্বালানি, যা ১০টি বোমা বানাতে যথেষ্ট...যদি ধ্বংস না হয়?

ধারণা করা হয়, গোপন খনির গভীরে লুকানো থাকতে পারে সেই জ্বালানি। ইসরায়েল হয়তো ইরানের কয়েকজন পরমাণু বিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে। কিন্তু কোনো বোমাই দেশটির জ্ঞান ও দক্ষতা ধ্বংস করতে পারবে না।

ইসরায়েলের আক্রমণের জেরে ইরানের নেতৃত্ব যদি মনে করে, আরো আক্রমণ প্রতিহত করার একমাত্র উপায় হলো যত দ্রুত সম্ভব পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা করা? ইরানের নতুন সামরিক নেতারা যদি তাদের মৃত পূর্বসূরীদের চেয়ে বেশি একগুঁয়ে ও কম সতর্ক হন, তাহলে কী হবে?

অন্ততপক্ষে, এটি ইসরায়েলকে আরো আক্রমণ করতে বাধ্য করতে পারে, যার ফলে অঞ্চলটি ক্রমাগত আক্রমণ-পাল্টাআক্রমণের চক্রে আবদ্ধ হয়ে পড়তে পারে। ইসরায়েলিদের কাছে এই কৌশলের একটি নির্মম নাম রয়েছে; তারা একে বলে ‘ঘাস কাটা’।

বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ধাক্কা

তেলের দাম ইতিমধ্যে ঊর্ধ্বমুখী। ইরান যদি হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে জ্বালানি পরিবহন আরো সীমিত করার চেষ্টা করে তাহলে কী হবে? ইয়েমেনের হুতি গোষ্ঠী যদি লোহিত সাগরে জাহাজ চলাচলের পথ আক্রমণে তৎপরতা দ্বিগুণ করে? তাহলে তারাই ইরানের সর্বশেষ তথাকথিত প্রক্সি বা মিত্র, যাদের অপ্রত্যাশিতভাবে ব্যাপক ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা রয়েছে।

বিশ্বের অনেক দেশই ইতিমধ্যে জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে সংকটে। তেলের ক্রমবর্ধমান দাম বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি আরো বাড়িয়ে দেবে। তা ছাড়া আগে থেকেই ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধে নাজেহাল মুদ্রা পরিস্থিতি। ভুলে গেলে চলবে না, তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে যে ব্যক্তিটি উপকৃত হচ্ছেন, তার নাম ভ্লাদিমির পুতিন। তিনি ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য ক্রেমলিনের কোষাগারে সহসাই আরো বিলিয়ন ডলার যোগাতে পারবেন।

ইরানি শাসনব্যবস্থার পতনে শূন্যতা তৈরি হতে পারে

যদি ইরানের ইসলামী বিপ্লবের শাসনব্যবস্থার পতন ঘটানোর দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যে ইসরায়েল সফল হয়, তাহলে কী হবে? নেতানিয়াহু বলেছিলেন, তার প্রাথমিক লক্ষ্য ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা ধ্বংস করা। কিন্তু অল্প সময়ের ব্যবধানে এক বিবৃতিতে তিনি স্পষ্ট করেছেন, তার বৃহত্তর লক্ষ্য শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন।

ইরানের জনগণের উদ্দেশে ভাষণে নেতানিয়াহু বলেছেন, ইসরায়েলের আক্রমণ ইরানিদের ‘খারাপ ও নিপীড়ক শাসন’ থেকে মুক্তির পথ পরিষ্কার করছে।

ইরানের সরকার পতন ওই অঞ্চলের কিছু লোকের কাছে, বিশেষ করে কিছু ইসরায়েলির কাছে আকর্ষণীয় হতে পারে। কিন্তু এর ফলে কী ধরনের শূন্যতা তৈরি হতে পারে? এর অপ্রত্যাশিত পরিণতি কী হবে? ইরানে যদি গৃহযুদ্ধ বেঁধে যায় তার চেহারা কেমন হবে?

ইরাক ও লিবিয়ার উদাহরণ টানা যেতে পারে, দুই দেশেই শক্তিশালী সরকারকে অপসারণের পর কী পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।

তাই আগামী কয়েক দিন ইরান-ইসরায়েলের সংঘাত কোন পথে এগোয় তার ওপর নির্ভর করছে বিশ্ব রাজনীতি, বিশ্ব অর্থনীতির গতিপথসহ অনেক কিছু।

সূত্র: বিবিসি

বাংলাফ্লো/আফি

Leave a Comment

Comments 0